হালের আমজনতা এবং ফটোগ্রাফি

শার্ল বোদলেয়ার

অনুবাদ: ইমরান ফিরদাউস

 

আমি বলতে চাইছি ঐসব আর্টিস্টদের কথা যারা দর্শকদের তাক লাগাতে পছন্দ করেন। তাক লাগানোর বাসনা ও চমকে যাবার ক্ষমতা উভয়ই নিয়মসম্মত। তবে ‘বিস্মিত হওয়ার’ সুখ যেমন আছে তেমনি ‘স্বপ্নকাতরতাও সুখের’। তুমি যদি আমা হতে শিল্পী অথবা শিল্পরসিকের তকমা পাবার জন্য গোঁ ধরে থাকো, তবে আমার প্রশ্ন হলো: কি উপায়ে নিজের কোনো  সৃষ্টিতে বিস্ময়ের উত্তাপ ছড়িয়ে দিতে চাও বা কি দ্বারা বিস্মিত  অনুভব কর? সুন্দর মাত্রেই বিস্মিত করে, তাই বলে বিস্মিত করার উপাদান থাকলেই সেটা সুন্দর হয়ে যাবে না। এখন, ফরাসী জনগণের দিকে চোখ ফেরালে দেখা যাবে, তাদের সংকীর্ণ হৃদয় স্বপ্ন দেখা বা মুগ্ধতার আনন্দ ধারনে একান্তই অক্ষম। সকলে বরং চায় পিলে চমকানো শিহরণ, হোক তা শিল্পের সাথে সাযুজ্যহীন কোনো উপায়। আর তাদের বাধ্যগত শিল্পীগণ, জন-রুচির কাছে নতজানু হয়ে থাকেন; তাদের লক্ষ্য বরাবরই দৃষ্টি আকর্ষণ করা, চমকে দেয়া এবং কুৎসিত কৌশলে বেকুব বানানো, কারণ, তারা পরিস্কার জানে পাবলিকের প্রকৃত শিল্প হতে পরমানন্দ উপভোগের ক্ষমতা নাই।

এই শোচনীয় কালে আরেকটি নতুন ইন্ডাস্ট্রির বিকাশ ঘটেছে যার দরুন  পাবলিকের  বেকুবি বিশ্বাস আরো পোক্ত হল। তাতে করে ফরাসি মনের যা কিছু নিবু নিবু দিব্য-আলো অবশিষ্ট ছিল এবার তাও নিবতে বসল।  স্বাভাবিকভাবেই আকৃতি পূজার বাড়বাড়ন্ত এমন একটা আদর্শে আরাধনা করছিল যাতে নিজস্ব প্রকৃতিরও বিগ্রহ স্থাপন করা যায়।  এই মুহুর্তে বিশেষ করে ফরাসি দেশে পেইন্টিংস ও খোদাইশিল্পের ক্ষেত্রে প্রচলিত শিল্প-বিশ্বাস হলো (এর বিপরীতে কারও কিছু বলার স্পর্ধা আছে বলে আমি  বিশ্বাস করি না) ‘আমি প্রকৃতির ভজনা করি এবং প্রকৃতির অকৃত্রিম পূজারি’ (এর কিছু ভালো কারণও আছে)। ‘আমি বিশ্বাস করি আর্ট শুধু মাত্র তাই যা প্রকৃতির অবিকল পুনরুৎপাদন করে মাত্র’ (একদল ভীরু সম্প্রদায়, স্বাভাবিক ভাবে অস্বস্তিকর বস্তু সমূহকে ছবি থেকে বাদ দিতে চান, যেমন, শয়নকক্ষে ব্যবহার্য মূত্রধানী অথবা মানব কংকাল)’। ‘যদি একটি ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রক্রিয়া, প্রকৃতির অবিকল  ছবি তুলতে পারে, তবে সেটিই হবে পরম শিল্প’ তো, এইসব কথা একদা এক প্রতিহিংসাপরায়ণ খোদার কানে পৌঁছুলে তিনি দাগুয়েখ নাম্নী চিত্রকর-রসায়নবিদ কে ইমাম মাহাদি করে তাদের উদ্দেশ্যে পাঠান। তখন তারা নিজদেরকে বলল, ‘যেহেতু ফটোগ্রাফি আমাদের নির্ভুলতার পরিপূর্ণ গ্যারান্টি দিচ্ছে (তারা তা সত্যিই বিশ্বাস করল, হায়রে পাগল! ) তাই আলোকচিত্রই হচ্ছে শিল্প’। আর ঐ মুহূর্তে থেকে আমাদের জঘন্য সমাজ  নার্সিসাসের মতন  ছুটে গেল ঐ মেটালিক প্লেটের প্রতি যা নিতান্ত মামুলি ছবি ধারণকরে। এক প্রকার বিকারগ্রস্থতা, অন্ধ উন্মত্ততা, এই নয়া সূর্য উপাসকদের অধিকার করে নেয়। একধরণের কদর্যতা তাদের মাঝে ফুটে উঠে। জনা কয়েক ইতর নারী-পুরুষ এক জায়গায় জড়ো করে ধোপা/কসাইয়ের সাজ-পোশাকে  ফটো খিঁচে তারা ভাবছে আহা প্রাচীন সমাজের আনন্দ-বেদনার ছবি তুলে ফেললাম।

আলোকচিত্রের আধুলি কথন

ভাল্টার বেনিয়ামিন

অনুবাদ: মুসতাইন জহির

 

…শিল্প নবিশীর অভিজ্ঞতার জন্য নয় বরং নতুন কায়দা রপ্তকরণে সিদ্ধহস্ত হবার উপরেই আলোকচিত্রে তাদের যাবতীয় মুনশিয়ানা দিতে হয়। ক্রমে এই মধ্যম প্রজন্ম কালের অতলে মিলায়া যায়। মনে হয় যেন আদিপুস্তক বাইবেল কথিত বিশেষ কৃপাধন্য হইয়া নাদার, স্টেলজনার, পিয়ারসন, বেয়ার্ড প্রভৃতি সবাই বয়সের কোটা আশি কি নব্বই ছুঁইতে পারছে। যদিও শেষতক, সবদিকের লোকেরা পেশাদারি আলোকচিত্রের ব্যবসায় ঢুইকা পড়ে। যখন নেগেটিভ বাড়তি ঘষামাজা কইরা ছবি বাইর করার ধুম লাগে, তখন বাজে চিত্রকরদের পোয়াবারো হয় আলোকচিত্রের উপর প্রতিশোধ নেয়ার। চটজলদি উনা রুচি দশদিক দখল করতে থাকে। এসময়ই আলোকচিত্রের এ্যালবামের চল শুরু হয়। বাসাবাড়ির ঠাণ্ডা জায়গায়, সাজানো টেবিলে, বসবার ঘরে তখন ছবির এ্যালবাম দৃষ্টিগ্রাহ্য কইরা রাখা হইত। চামড়া দিয়া বাঁধাই করা চকচকে ধাতব পাতের ফ্রেমে: অ্যালেক্স চাচা কিম্বা রিখি খালা, ট্রুডি যখন পিচ্চি ছিল, বাবার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বছর, ইত্যাকার ছবিতে ভইরা থাকত। শেষমেশ নিজের দুষ্টামিভরা কিছু দৃশ্য না থাকলে ওটা যেন সম্পূর্ণ হইত না। এই যেমন: নরসুন্দরের মত চুল কাটার অঙ্গভঙ্গি, হাত-পা নাইড়া হেড়ে গলায় গান, আগুনের ফুলকি আঁকা কোন ছবির কাছে আগুন নেভানোর ভঙ্গিতে হ্যাট নাড়ানো, ভারিক্কি চালে নাবিক সুলভ কেতা, কিম্বা এক পায়ে ঠেস দিয়া খাড়ানোর বিশেষ কোনো ভঙ্গিমা।

এইসব পোট্রেট-এ কোন খুটিঁ বা স্তম্ভ কিংবা ডিম্বাকৃতির টেবিল জাতীয় উপকরণাদি ব্যবহার করা হইত যাতে ঠেস দেয়া যায়। ওটা এক্সপোজারকালীন লম্বা সময়টাতে মডেলের সটান রাখার দরকারের কথাই মনে করাবে। মাথা কিংবা হাঁটু সোজা রাখতে ব্যবহৃত উপকরণাদি পয়লা পয়লা যথেষ্ট মনে হইলেও পরে তা বিখ্যাত চিত্রকলার অনুকরণে ফ্রেমে আরো সব শৈল্পিক উপাদান যুক্ত করে মানুষজনের চাহিদা তৃপ্ত করার পথ ধরে। এরই হাত ধইরা আসে কলাম এবং পর্দা। অবশ্য সমঝদাররা সেই ষাটের দশকেই তাতে আপত্তি তোলে। পেশাদার এক ইংরাজি জার্নালে প্রশ্ন তোলা হয়: ‘চিত্রকলার মধ্যে কলাম না হয় বুঝা গেল, কিন্তু আলোকচিত্রে যেভাবে এটা ঢুকানো হইছে তাতে তো কিম্ভূতকিমাকার ধারণ করছে। সাধারণত দেখা যায় মডেল কার্পেটের উপরই দণ্ডায়মান। তো, মার্বেল বা পাথরের কলাম কার্পেটের উপর ভিত গাইড়া মাথা তুইলা আছে এটা কারো পক্ষে কল্পনা করা সম্ভব?’ এটা ছিল সেইসব স্টুডিওর জমানা যেখানে ঝালর শোভিত পাম গাছ, কারুকাজময় সজ্জা এবং ক্যানভাস ঝুলিয়ে রাখার ফ্রেম ইত্যাকার নানাবিধ উপকরণে ভর্তি কক্ষটা যেন ছবির উপস্থাপন বা ফাঁসির বেদি, নির্যাতন কক্ষ বা রাজাসনের মত দ্বিবিধ চরিত্র নিয়া দ্বিধাগ্রস্ত হ’য়া থাকত। কাফকার প্রথমদিকার একটা পোট্রেট যার সরস নজির হ’য়া আছে। সম্ভবত বছর ছয়েকের একটা বাচ্চা, খুবই আটোসাটো বিব্রতকর একটা স্যুট পরে শীতকালের কোনো বাগানে দাঁড়ায়া আছে। পিছনে পামগাছের পাতাগুলা যেন ঠাণ্ডায় কুঁকড়ে আছে। যেন ঐসব আদ্দিকালের রদ্দিমার্কা জিনিসে ঠাসা পরিবেশটাকে আরো গুমোট করে তুলতে বেমানান একটা বড়সড় হ্যাট (এ ধরনের হ্যাট স্প্যানিশরা পরে) বাম হাতে নিয়া খাড়ায়া আছে। আমরা আশপাশের এতসব কিছুর ভিতরেই হারায়া যাইতাম যদি না তার নিঃসীম বিমর্ষ চোখগুলা আর সব ছাপায়ে জায়গা কইরা নিবার প্রাণপণ আকুতিতে ভর্তি না থাকত।

অসীম বেদনার ভেলায় ভাসানো ছবিটা পয়লা জমানার সব আলোকচিত্রের প্রতিমূর্তি বনছে মনে লয়…

ফটোগ্রাফী

সুকুমার রায়

‘সুন্দর’ বস্তু বা দৃশ্যের যথাযথ ফটোগ্রাফ লইলেই তাহা ‘‘সুন্দর’’ ফটোগ্রাফ হয় না। কারণ, আমাদের চোখের দেখা ও ফটোগ্রাফীর দেখায় অনেক প্রভেদ। জিনিসের গঠন ও আকৃতি ফটোগ্রাফে চাক্ষুষ প্রতিবিম্বেরই অনুরূপ হইলেও প্রাকৃতিক বর্ণবৈচিত্র্য ফটোগ্রাফে কেবল ঔজ্জ্বল্যের তারতম্য মাত্রে অনূদিত হইয়া অনেক সময় ভিন্ন মূর্তি ধারণ করে। অনেকেই লক্ষ্য করিয়া থাকিবেন, সাধারণত হরিদ পীতাদি উজ্জ্বল বর্ণ ফটোগ্রাফে অত্যন্ত ম্লান দেখা যায় এবং নীল ও নীলাভ বর্ণগুলি অস্বাভাবিক উজ্জ্বল হইয়া পড়ে।

সুতরাং আকাশের নীলিমা ও মেঘের শুভ্রতা একই রূপ ধারণ করায় শাদা কাগজ হইতে তাহাদের পার্থক্য করা কঠিন হইয়া পড়ে। শ্যামল প্রান্তরের মধ্যে প্রকৃতির স্নিগ্ধোজ্জ্বল কারুকার্য সাধারণ ফটোগ্রাফে একঘেয়ে কালির টানের মতো মিলাইয়া যায়। অবশ্য ফটোগ্রাফীর বর্তমান উন্নত অবস্থায় এ সকল দোষের সংশোধন অসম্ভব নহে এবং বর্ণের ঔজ্জ্বল্য ফটোগ্রাফে যথাযথভাবে প্রকাশ করিবারও উপায় আবিষ্কৃত হইয়াছে।

কিন্তু শিল্পের দিক দিয়া আর একটি গুরুতর সমস্যা ও অন্তরায় রহিয়াছে।

ঘোলাটে ছবির আখ্যান

তানজিম ওয়াহাব

 

স্যালন  ফটোগ্রাফির আলোচনায় স্যালন  পেইন্টিং থেকেই ঘুরে আসতে হবে। প্যারিসে ১৭২৫ সালে স্যালন’’র প্রচলন ঘটে যখন ফরাসি সরকার শিল্পমান যাচাই আর শিল্পপ্রদর্শনী আয়োজনের লক্ষে তৈরি করে এক একাডেমি একাদেমি দে ব্যু আর্ট)। একাডেমি স্বীকৃত না হলে কারো ছবি প্রদর্শন হতো না, যার সিদ্ধান্ত নিত শুধুমাত্র সরকার নির্ধারিত বাক্তিবর্গ। তাদের পছন্দের তালিকায় ছিল বাইবেলীয় আখ্যান , পৌরাণিক বিষয়বস্ত যা শিল্পীর কল্পনাশক্তি নান্দনিকভাবে উপস্থাপন করে বটে, তবে তা বাস্তবতা বিবর্জিত। চিত্রকলার ইমপ্রেসনিজম আন্দোলনের সময় এই ধারার প্যারিস স্যালনের সাথে ইম্প্রেসনিস্ট শিল্পীদের সরাসরি সংঘাত ঘটে। প্যারিস স্যালনের শিল্পের একক সংজ্ঞায়ন তারা নাকচ করে দেয়। যেমন ধরুন শিল্পে নগ্নতা নিয়ে প্যারিস স্যালনের ভাষ্য। তাদের ভষ্য মানুষের নগ্নতা (বিশেষ করে নারীর) শিল্পে শুধুমাত্র উত্তীর্ণ হতে পারে যখন তা আবেদনময়, কিন্তু নেংটো উপস্থাপন হল শিল্পবিমুখ অশ্লীলতা। ইংরেজিতে ন্যুড আর নেকেড এর সংজ্ঞায়ন জটিলতা বলতে পারেন। বুঝেন ঠ্যালা? ইমপ্রেসনিস্ট আর রিয়েলিস্ট শিল্পীরা প্রতিবাদস্বরূপ রীতিমত ব্যাঙ্গ করা শুরু করল। রিয়েলিস্ট পেইন্টার অনরে দোমিয়ের সেইসময়ের অসংখ্য ক্যারিকেচার স্যালন পেইন্টিংকে ব্যাঙ্গ করে বুর্জোয়া শিল্পচর্চা হিসেবে।

বিতর্ক শুরু হলেও  স্যালন  পেইন্টিং তার নির্দিষ্ট চরিত্রেই অনড় থাকে- অতি নান্দনিক, কাল্পনিক দৃশ্যায়ন, আলোছায়ার নাটকীয়তা আর সুন্দর, মঙ্গলময় জীবনের গুণকীর্তন। । কেন হঠাৎ স্যালন পেইন্টিং নিয়ে বললাম?

আলোকচিত্রের চোখে দেখা

এডওয়ার্ড ওয়েস্টন

অনুবাদ: সাইফুল হক অমি

মূলত এই ভুল ধারণা আতঙ্কজনক সব অনাসৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়াল। অদ্ভুত পোশাকের ব্যবহার থেকে শুরু করে অর্থহীন আউট অফ ফোকাস—এ সবকিছুই করা হয়েছিলো শিল্পের দোহাই পেড়ে।

আলোকচিত্র উল্টা পথে চলার পেছনে এইটাই একমাত্র কারণ নয়। আসল সংকট তৈরি হয়  ভ্রান্তসব মানদণ্ড খাঁড়া করার মধ্যে।  চিত্রকলার অনুরূপ ফটো-পেইন্টিং  তৈরি করা আলোকচিত্রির লক্ষ্য হয়ে দাঁড়াল।  আলোকচিত্র মাধ্যমের নিজস্ব প্রকৃতি বিরোধী একেবারে বেখাপ্পা চর্চায় নিয়োজিত থাকল ফটো-পেইন্টাররা। পরিণতিতে, আলোকচিত্র মাধ্যমের প্রতিটা গুণগত বিকাশ সেই সব অবিমৃশ্যকারীদের সামনে একেকটা বাঁধা তৈরি করল। আলোকচিত্র যে বিপুল সৃষ্টিশীল সম্ভাবনা নিয়ে হাজির হয়েছিল, চিত্রকলাবাদী ধারার প্রভাব  স্বীকৃতি লাভের সেই সময়টা অনেক পিছিয়ে দেয়। দৃশ্যজগত উন্মোচনের নতুন উপায় হাতে পেয়ে যাদের আবিষ্কারে মনোযোগী হবার কথা তারাই বরং সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করলেন মাধ্যমটির নিহিত সম্ভাবনা। আর চিত্রকলার মত করে আলোকচিত্র সৃষ্টির ভুত চাপে তাদের মাথায়, যা  ক্রমাগত আলোকচিত্রের সব মূল্যচেতনা থেকে মৌলিকভাবে তাদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলে  ।

ফলাফল দাঁড়াল, যখন আমরা অতীতের সেরা কাজগুলোর হিসেব নিতে বসি তখন আমাদের প্রায়শঃ তাদের কাজগুলোই নির্বাচন করতে হয়, যারা নন্দনতত্ত্ব নিয়ে অতটা মাথা ঘামায় নি। সেটি হতে পারে কোনও বাণিজ্যিক ‘দাগরেটাইপ’ আমলের পোট্রেট, গৃহযুদ্ধের  প্রামাণ্য ছবি, কিংবা আমেরিকার যুদ্বক্ষেত্রের ছবি। মোট কথা, সেই সব শখের কিংবা পেশাদারি আলোকচিত্রীরা কাজ করেছিলেন তাদের আপন তাগিদে, আলোকচিত্র মাধ্যমটি আদতে কোনও শিল্পমাধ্যম কিনা তা নিয়ে তারা মোটেই বিচলিত ছিলেন না। ফলে সেই যুগ থেকে আমরা এমন কাজ খুঁজে পাই যা  সমকালীন সেরা কাজের মধ্যেও টিকে থাকতে পারে।

কিন্তু ইতিহাসের এই পর্বকে আমরা আশি বছর পর যখন আবেগ কাটিয়ে ঐতিহাসিক চোখ দিয়ে বুঝতে যাই, তখন দেখি আজও পরিস্থিতি আগের মতই তালগোল পাকানো। চিত্রকলার ঐতিহ্যের সাথে এখনও যা সেঁটে আছে-বিশেষ ধরনের টেক্সচারের পর্দা, নেগেটিভের উপর হাতের কাজ; আর ধরা-বাধা কম্পোজিশনের দিকে তাকালেই তা বোঝা যায়।  যারা ছাকনি দিয়ে কুয়া থেকে জল তোলার পণ্ডশ্রম করে তাদের পক্ষেই ক্যামেরা দিয়ে চিত্রকলা তৈরির কারবারে নামা সম্ভব! ফটো-পেইন্টিং  প্রবণতার  পেছনে এই বদ্ধমূল ধারনা ছিল যে, সরাসরি তুলে আনা ছবি  নেহাতই একটি যান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ফল আর তা স্বাভাবিক কারণেই শিল্প হতে পারে না। সেই শিল্পী তখন যান্ত্রিকতার অপবাদ ঘুচাবার জন্য বিশেষ সব কৌশল প্রয়োগ করতে শুরু করলো। এই পদ্ধতিতে নেগেটিভকে ধরা হয়েছিল নতুন কর্মপদ্ধতির সূচনা হিসেবে- যার প্রাথমিক রুক্ষ চেহারা হাত দিয়ে ঠিকঠাক করা হয় ঠিক ততক্ষন পর্যন্ত, যতক্ষণ  না এর  অ-শৈল্পিক উৎসের শেষ চিহ্নটুকু  মুছে যায়।

এটা হয়ত গায়ক গায়িকারা একজোট হয়ে যন্ত্রীদের বুঝিয়ে ফেলার মত যে, যন্ত্রীরা যে সুর সৃষ্টি করেন তা শিল্প নয়। কেননা তা সৃষ্টি হচ্ছে যন্ত্রীদের ব্যবহৃত যন্ত্র থেকে যা অবশ্যই প্রাথমিকভাবে একটি যান্ত্রিক পদ্ধতির ফলাফল। তখন যন্ত্রীরা  ফটো-পেইন্টিং এর  নজির কাজে লাগিয়ে সুরকে এমন একটি ফিতায় বন্ধী করতে পারবেন, যেন তারা ক্রমাগত তাকে পরিবর্তন করতে পারেন। যতক্ষণ পর্যন্ত না একটি সঙ্গীত-যন্ত্রের উৎকৃষ্ট সুরমূর্চ্ছনা মানব কণ্ঠের অন্ধ অনুকরণে পর্যবসিত হয়।  আলোকচিত্র মাধ্যমটির স্বরূপ বুঝতে হলে আমাদের  মূল দুইটি বিষয় বুঝতে হবে যা আলোকচিত্রকে অন্য গ্রাফিক আর্ট থেকে  পৃথক করে।

নিঃসঙ্গ প্রকৃতির রূপকার

ডঃ নওয়াজেশ আহমেদ

আলাপচারিতা: নাসির আলী মামুন

 

নওয়াজেশ আহমেদ: তখন আমার সঙ্গে ছিলেন বর্তমানে জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। উনিও একজন মেম্বার ছিলেন। আমাকে বলছিলো, আপনি কলকাতায় যান। কলকাতায় গিয়ে আরো কিছু ছবি বেছে নিয়ে এসে এটা করেন। আমি একটা অজুহাত দেখালাম যে কলকাতা যেতে পারবো না। না গিয়ে বুদ্ধি করে এখানে দু’’টো পার্ট করলাম। একটা স্বাধীনতা আর মুক্তিযুদ্ধের ওপর, বাকিটা রূপসী বাংলা, ‘হে বাংলা আমার। কার জন্য যুদ্ধ?’ এই বাংলার জন্যই তো, যে জন্য আমাকে প্রচুর বিরোধিতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিলো। কেউ ছবি দিতে চাচ্ছিলো না।  অ্যানি ওয়ে, আমি বলবো যে  আমাদের ওই এক্সিবিশনটা খুবই সাকসেসফুল, সত্যিকারের উন্নতমানের একটা জাতীয় প্রদর্শনী হয়েছিলো। স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রচুর ছবি ছিলো, আরেকদিকে গ্রাম বাংলার ছবি। আমরা বলেছিলাম যে যদি এই পোরশনটা না দেখাই, তবে আমাদের আলোকচিত্র স্থান পাবে না। বঙ্গবন্ধু আসলেন, দেখলেন, খুবই খুশী হলেন এবং বললেন যে, ‘তোরা আর কি কি করতেছস?’ যেহেতু আর্ট কলেজের মধ্যে হচ্ছিলো, ওখানে আর্ট কলেজের প্রিন্সিপালও ছিলেন। তখন প্রিন্সিপাল ছিলেন জয়নুল আবেদীন। তাকে আমি বললাম, তিনি বললেন যে, ‘হ্যাঁ, এটা তো ভালো কথা। এটা তো আমাদের অনেক আগেকার আইডিয়া ছিলো’। বললেন, ‘নায়েবউদ্দীনকে ডাক দেন। কারণ তার কতগুলি প্রিয় লোক ছিলো। আমানুল হককে একটু ডাকেন’।

আমি এদেরকে ডেকেছিলাম। আমানুল হক সাহেব অসুস্থ থাকায় আসেননি। নায়েবউদ্দীন সাহেব, আমি, কিছু প্রেস ফটোগ্রাফার ছিলাম। সব মিলে বলা হলো আবেদীন সাহেবকে, ‘আপনি যেটা করতে পারেন’। আমাকে বললো, যেহেতু আমি বহু দেশ ঘুরে এসব আর্ট ইন্সটিটিউট দেখেছি। আমাকে বললেন, ‘আপনি কোন জায়গায় কি দেখেছেন বলেন’। আমি বললাম, স্পেশালাইজড হয় দুই বছর। সিনেমাটোগ্রাফি এখন না, কারণ এটা একটু হেভি। কিন্তু স্টিল ফটোগ্রাফি করা যেতে পারে। উনি রাজি হলেন। তারপর ’৭৫ এসে গেলো। গন্ডগোল হলো। আমিও দেশ ছেড়ে কাজে গেলাম। পরবর্তীতে জিনিসটা ভাটার মধ্যে চলে গেলো। কিন্তু আলোকচিত্রীদের মধ্যে একটা দল বললো যে, তারা আর্ট কলেজের সঙ্গে না রেখে নিজস্ব একটা ইন্সটিটিউট করবে। আমার মনে হয় সেটা একটা ফ্যাক্টর।

নাসির আলী মামুন: এই দলে কারা ছিল?

নওয়াজেশ আহমেদ: আমি ঠিক জানি না। আমি তখন দেশের বাইরে। শুনলাম। আর্ট কলেজের কাইয়ুম চৌধুরী, যারা গ্রাফিক্স নিয়ে কাজ করে তারা খুব ইন্টেরেস্টেড ছিলো। তারা আমাকে বললো যে ফটোগ্রাফাররা তো অন্য কথা বলে…..

ফটোগ্রাফি উইদাউট ক্যামেরা!

বিজন সরকার

আলাপচারিতা: মুনেম ওয়াসিফ

মুনেম ওয়াসিফ: তো, আপনার একভাই তো সাইনবোর্ড ব্যানার এসব আঁকতেন, আরেক ভাই কী করতেন?

বিজন সরকার: সে-ও এই কাজই করতেন। যেহেতু তাঁরা তিন বছরের বড়-ছোট ছিলো, তো ন্যাচারালি ফ্রেন্ডসও হয়েছে সেরকম । আর আমি বড় ভাইয়ের তের বছরের ছোট। বিরাট একটা গ্যাপ রয়েছে। গ্যাপের জন্যই বোধহয় আমার ভাইয়ের প্রতি আলাদা একটা ভালোবাসা ছিলো, আবার বিস্ময়করও ছিলো যে উনি বহু কাজ করতেন। বহু কাজ করতো বলতে এইটা মনে হয় প্রতিভাবানদের ব্যাপারে কথাটা হল জুতা সেলাই থেকে চণ্ডিপাঠ পর্যন্ত একটা কথা আছে মানে যা পায় তাই করে এরকম আর কি! সে একসময় কম্পাউন্ডারিও করসে।

মুনেম ওয়াসিফ: তো, সে এরকম নানান কাজে পারদর্শী ছিলো?

বিজন সরকার: নানান কাজে। মানে, আমি যতদূর জানি আর কি! দোকানের হিসাব রাখার কাজ করত, আবার কম্পাউন্ডারিও করতো। বিভিন্ন লেখালেখি এইসবের মধ্যে ছিলো। সে ছবি আঁকাতে যখন আরেকটু বেশি দিন কাটালো, অনেক কিছু করলো, তখন সে মূর্তি বানানো শুরু করলো। প্রতিমা-স্বরস্বতী, লক্ষ্মী এগুলো। স্বরস্বতী পূজা তো আমাদের ব্যাপকভাবে প্রচলন আছে। তো মূর্তি বানানোর ক্ষেত্রেও অনেকরকম জ্ঞান দরকার। আমি ছোটবেলায় দেখেছি, যে মাটিটা ছানতো, ঐ মাটির ভেতরে আগে পাট কেটে দিতো, পরে আবার ধানের তুষ মেশাচ্ছে। আমি বলি ‘এগুলা দিলে কেন?’ ও বলে ‘এইটা আরো ছোট অংশে মাটি ধরে রাখে’, এইরকম আরো কি সব বললো যেটা মনে নাই। উনার এক আর্টিস্ট ফ্রেন্ড ছিলো কলকাতায়। উনাদের যে কাজ-কাম বা বিচরণ সবই কলকাতা ভিত্তিক আর কি। সেই কারণে পাকিস্তান যখন আলাদা  হলো তখন উনি আসামে ছিলেন। উনি এই ধরনের নানান সৃজনশীল কাজের মধ্যেই ব্যাপ্ত ছিলেন… যেহেতু ভাইয়ের অনুপ্রেরণা আমি পেয়েছি, তাই কিছুটা বলতেই হবে। উনি বোধহয় ফোরটি ফাইভ এর দিকে, কিংবা ফোরটি ফোর এর দিকে হতে পারে, মিনিট ক্যামেরা ব্যবহার করতেন। পেপার নেগেটিভ।

মুনেম ওয়াসিফ: কিন্তু আপনি প্রথম ক্যামেরা হাতে পাইলেন কবে বা শুরু করলেন কবে?

বিজন সরকার: এই অনুপ্রেরণাটার প্রয়োজন আছে, সেইজন্যই বলি। এর মাঝখানের পিরিয়ডে, বড় ভাই কথা-বার্তা বলতো ছোটভাইয়ের সাথে। আমার সঙ্গে না, আমি তো তখন কথা বলার অযোগ্য। দশ বছরের ডিফারেন্স, আমার সঙ্গে কী কথা বলবে? মেঝ ভাইকে বলতো, লাইটিং সম্বন্ধে। তারপর একটা ভেরি ইম্পোর্ট্যান্ট কথা বলেছে। নাচে বা গানে পুরস্কার পেয়েছে, এটা নিয়ে বলছেন যে কোন বিচারক বিচার করেছে, সে কি বোঝে এই কাজ? কিংবা এরাই বা কার কাছে দেয় বিচার করার জন্য? কোনো শিল্প কোনোদিন বিচার করার অধিকার কারো নাই। ওই কথাগুলো বলছে। শিল্প তো হচ্ছে সাধনার বিষয়, এটা সারাজীবন শুধু সাধনা করে যেতে হয়। এর মাধ্যমেই যাবতীয় উত্তরণ হয়। কী অদ্ভুত কথা না?

মুনেম ওয়াসিফ: অনেক মূল্যবান কথা।

বিজন সরকার: অনেক মূল্যবান কথা না? এটা ভাইয়ের কাছ থেকে শোনা। ভাই তো আমাকে পাত্তাই দেবে না, এই কথা শোনাবে? ‘এই ভাগ, ডিস্টার্ব করিস না’, এই কথা বলতো আর কি! কিন্তু এই কথা ভাইয়ের কাছ থেকে শুনেছি। তারপর লাইটিং সম্বন্ধে বলত, কোথায় কোন লাইটিং। ধরেন, এখানে বসলে ডান দিকের যে লাইটিংটা আসবে, এই লাইটেই এইদিকে মুখটা ঘোরালে পরে দুই মুখেই আসবে। এদিকটা শেড, এইদিকটায়। এইসব কথা আমি তখনই বুঝতে পারতাম। তারপরে খোলা জায়গায় বারান্দায় একটা ঘর আছে, তার চাল নেই। তার সামনে যদি দুই-তিন হাত উপরে দিয়ে একটা কালো কাপড় মাথার ওপর দিয়ে দেয়া হয়, তাহলে পাসপোর্ট ছবি খুব ভালো আসবে। লাইট দুই দিকে যদি সমান থাকে তাহলে একরকম লাইট হবে, একদিক যদি বেশী থাকে থাকে তাইলে হালকা লাইট অ্যান্ড শেড হবে। চমৎকার কথা না? এইগুলা তো আমি জ্ঞান হওয়ার আগেই শিখেছি। বড় ভাই বলতো এইগুলো।

মুনেম ওয়াসিফ: তখন আপনার বয়স কত হবে? ৭-৮-১০ বছর? স্কুল-টিস্কুলে পড়েন তখন?

বিজন সরকার: বয়স হবে… পাকিস্তান যখন হয়, ৪৭-এ, তখন আমি ১২ বছর। হিসাবটা আসলে…

মুনেম ওয়াসিফ: আচ্ছা বয়স গুরুত্বপূর্ণ না, আপনি গল্পটা বলতে থাকেন, যে কথাগুলো শুনছেন সেই সময়।

বিজন সরকার: এই জিনিসগুলা আমি পরে বুঝলাম যে আমার যে অনেক ক্রিয়েটিভ জ্ঞান আসছে, এইটা নিশ্চয়ই আমার ভাইয়ের কারণে। এইরকম আরো অনেক কথা আমি আমার ভাইয়ের কাছে শুনেছি। সব মনেও নাই। কিন্তু ভাইয়ের কারণে আমার এই ক্রিয়েটিভ জ্ঞানটা হইসে। আমি এখন মনে করি অই যে আপনি আমার ওই ছবির ইন্টারভিউ নিতে চেয়েছেন, ঐটা আমি আর দিতে চাই না। চাই না এইজন্যে, যে কাজ আমি ষাটের দশকে করেছি, সেই কাজ আজও বাংলাদেশের কোনো ফটোগ্রাফার জানে না। ঔৎসুক্যও কেউ প্রকাশ করে নি। তাইলে আমি কি মনে করবো?…

সাতটি ছবি সাতটি গল্প

…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..

আমানুল হক

তানজিম ওয়াহাব

আমানুল-এর কেনা চোরাবাজারের সেকেন্ড হ্যান্ড জাপানী ক্যামেরা, তার কুঁজো, রোগা শরীরের ছিপছিপে গড়ন, খুব সাধারণ ঢিলে হাতা খদ্দরের পাঞ্জাবি, পায়জামা আর চপ্পল, মৃদু কণ্ঠের পরিমিত আলাপচারীতার সাথে ছবিটি মেলানোর চেষ্টা করছি। রীতিমত হিমশিম খাচ্ছি। শক্তিশালী কম্পোজিশন। দু’হাত মেলে দিয়ে দানবীয় ভঙ্গিতে এক মানব শরীর। পেছন থেকে তোলা, চেহারা দেখা যায় না, তবে আসল চেহারাটা অনুভূত হয়। ছবির মানুষটি নিয়ে একটু পরেই বলি, ছবির পেছনের যে মানুষ …

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….

নাইব উদ্দিন আহমেদ

মুনেম ওয়াসিফ

কিন্তু ছবি তোলা হলেই তো হবে না, সেই নেগেটিভ ধোলাই করা থেকে প্রিন্ট তৈরি পর্যন্ত সব কাজ তিনি নিজের হাতে করতেন। অন্ধকার ঘর, টেবিলের চারপাশে কাঁথা মুড়ানো আর হারিকেনের লাল সেলোফেন থেকে আসা আলতো আলো দিয়ে চলত ডার্করুমের কাজ। পানির ভিতর থেকে একটি সাদা কাগজ। লাল আলো। তার ভিতর থেকে আস্তে আস্তে ছবি বেরিয়ে আসতে দেখার যে কি প্রবল উত্তেজনা, তা এই প্রজন্মের অনেক আলোকচিত্রি বুঝবে না …

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….

ড: নওয়াজেশ আহমেদ

তানজিম ওয়াহাব

ছুটি পেয়ে রবীন্দ্রনাথের ফুলবাগানের ফুলগুলো অসংযত উচ্চহাসি দিলেও নওয়াজেশের ছবিতে তারা সম্পূর্ণ উল্টো ভঙ্গিতে। এখানে তারা প্রচণ্ড সংযত, পরিপাটিভাবে ফুলদানিতে সাজানো। এলোমেলোভাবে হেলাদোলার বদলে প্রচণ্ড স্থির, ঠাণ্ডা।  চৈত্রের পড়ন্ত রোদ তাদের পিঠে এসে না পড়লেও জানালার ফাঁক দিয়ে আলতোভাবে ছুঁয়ে যাচ্ছে। বাঁকাপথে আসার সময় কুঁচি কুঁচি হয়ে আলো কেটে আসছে জানালার গ্রিল থেকে …

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….

আনোয়ার হোসেন

মুনেম ওয়াসিফ

আমরা এখানে মায়া, আনোয়ার হোসেন, তাদের ঘর কিংবা আর কিছু দেখতে পাই না। কেবল একটি হাত, কাঁচি, সুতো আর সুই। এতো অল্পে কিভাবে জীবনের গল্প হয়ে যায়! এভাবেই আনোয়ার হোসেন মরা পাখি, স্যান্ডেল, পুরানো কাঁচি, তাবিজ, পানের ডিব্বা, কিংবা প্রিয় মানুষের শরীরের অংশবিশেষ নিয়ে এসেছেন তার এই কাজে। সরল, পরিমিত, স্বচ্ছ অথচ ছবিগুলো জার্মান টাইপোলজির মতো আবেগহীন নয়। এইগুলো আনোয়ার হোসেনের বেড়ে উঠার আখ্যান, একেকটি সাংকেতিক গল্প।

রঙের নদী: ভারতীয় চোখ

রঘুবীর সিং

অনুবাদ: আরফান আহমেদ

 

আলোকচিত্র যদি ভারতীয় আবিষ্কার হত, তাহলে আমার বিশ্বাস, পশ্চিমা আলোকচিত্রীগণ রঙে দেখাকে যেভাবে, তত্ত্বীয় ও শৈল্পিক সমস্যা হিসাবে গ্রহণ করেছেন তা কখনোই ওরকম হত না। রঙিন আলোকচিত্রকে খারিজ করার জন্য, অঁরি কার্তিয়ে ব্রেসো আড়ালে ফরাসি সেনাবাহিনীর খিস্তি ব্যাবহার করতেন, আর জনসমক্ষে বলতেন ওটা পেইন্টিং এর ক্ষেত্র। ওয়াল্কার ইভান্স রঙ্গীন আলোকচিত্রকে ঘোষণা করলেন অশ্লীল আর এন্দ্রে কার্তেজ তার বই এবং প্রদর্শনীতে কখনোই তার রঙ্গীন আলোকচিত্রগুলো ব্যাবহার করেন নি। যখন পুরো নতুন এক প্রজন্মের আলোকচিত্রীগণ রঙেকেই বেছে নিলেন, এ আলোকচিত্রীরা সাদা-কাল ছবির বিশেষ ও মূলগতঃ বৈশিষ্ট, তার দূরত্ববাচকতাকে রঙ্গিন ছবিতে এমনভাবে সংশ্লেষ করলেন, সেটি হয়ে উঠল আঙ্গিক ও আবেগের নতুন প্রকাশ।

ঔপনিবেশিকতার আগে এবং আলোকচিত্রেরও আগে, ভারতীয় শিল্পীগণ সাদাকালোতে কোনকিছুই দেখেননি, যদিও তারা রঙে পরিপূর্ণ সূক্ষ্ম ড্রইং তৈরি করেছেন। পশ্চিমে পরিচিত ড্রইং মাধ্যামটির অস্তিত্ব কখনোই ভারতে ছিল না নন্দনতাত্ত্বিক অথবা কৌশলগত ভাবে। ভারতের কখনোই কোন লিওনার্দো, রেঁম্ব্রা অথবা গয়া ছিল না। এমন কি মুঘল দরবারের অপরূপ সৌকর্যময় ড্রইং গুলো, পশ্চিমের ড্রইংগুলো থেকে একেবারে ভিন্ন। ওখানের ড্রইংগুলো সাধারনত রঙ দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে অথবা ‘ট্যান-ওয়াশ’ ব্যবহার করা হয়েছে যেমন ‘নীল কলম’। একটি অত্যাশ্চর্য ঘটনা ঘটে যখন ষোল শতকে আকবরের দরবারে, উপঢৌকন হিসাবে, গোয়ার খৃস্ট্ সঙ্ঘ কাঠ-খোদাইয়ে প্যাকেট করে রয়েল পলিগলট বাইবেল প্রদান করে। চমক কেটে যাওয়ার পর, সম্রাট এবং তাঁর সভাসদগণ এবং শিল্পীগণ নিশ্চিত ভাবেই কল্পনায় কাঠখোদাইয়ের খালি যায়গাগুলো রঙে পরিপূর্ণ করে ছিলেন। জাহাঙ্গীরের জন্য তৈরি করা, সতের শতকের বিখ্যাত শিল্পকর্ম, ইনায়েৎ খাঁ-র মৃত্যুতে ছিল না অন্ধকার আমেজ অথবা ইউরোপীয় মহৎ শিল্পকর্মের মত আলো-ছায়ার কারসাজি। ড্রইং ছিল পেইন্টিঙের প্রস্তুতি। এ ধরণের ড্রইংগুলো,রাজকীয় সংগ্রহশালার বদলে পাওয়া যায় শিল্পীদেরই নিজস্ব সংগ্রহশালায়। আজ এ ধরনের ড্রইং অপ্রতুল, যে ধরনের ড্রইংগুলি উজ্জ্বল মুঘল আর রাজপুত পেইন্টিং এ, তাদের গৌণ ভুমিকার ইঙ্গিত দেয়।

প্রাচীন কাল থেকেই ইহুদী-নাসারা দুনিয়া, রঙ দেখেছে তাত্ত্বিক অগ্রগতির চোখ দিয়ে। চাগাল-এর সময় পূর্ব পর্যন্ত ইহুদী সভ্যতার রঙ এবং রেপ্রেজেন্টেশন সম্পর্কে কোন ধারণাই ছিল না; সে সময়ে খৃস্ট সভ্যতাও রঙের প্রতি দেখিয়েছে বৈরীতা। ক্যেনেথ ক্লার্ক তার সিভিলাইজেশন বই এ আলাপ করেছেন, টার্নার এবং প্রকৃতির সাথে শিল্পের মনস্তাত্বিক সম্পর্ক বিষয়ে। তিনি এই বলে উপসংহার টানেন যে, ধারণা করা হত রঙ হল পাপাত্মক। হয়তোবা সত্যি, কারণ এটি হল তাৎক্ষণিক ভাবে উত্তেজনাকর এবং এটি নৈতিকতার ভিত্তি ক্রমিক স্মৃতি সমূহকে স্বাধীন ভাবে প্রভাবিত করে’। কলার এন্ড কালচার গ্রন্থে জন গেজ, রঙের নৈতিকতা সম্পর্কে পুরো একটি অধ্যায়ই লিখে ফেলেন, যা এরিস্টটোল থেকে শুরু হয়ে ক্যান্ডিন্সকি-তে এসে শেষ হয়। চার্লস এ. রিলে, কালার কোডস-এ বলেন, রঙ হল দুশ্চিন্তার উৎস…

উইলিয়াম ইগ্লস্টন গাইড পরিচিতি

জন সারকৌস্কি

অনুবাদ: সিউতি সবুর

 

জগতে যত না ইট ব্যবহৃত হয়েছে তার চেয়ে ফটোগ্রাফের সমাহার বেশী,এবং সবকটি ফটোগ্রাফই আশ্চর্যজনক ভাবে আলাদা। এমনকি সর্বোচ্চ নিষ্ঠাবান ফটোগ্রাফারের পক্ষেও শ্রেষ্ঠ ফটোগ্রাফারের প্রথমদিককার কাজ হুবহু নকল করা সম্ভব হয় নি।

এটা প্রমানের জন্য পাঠক চেয়ারে বসে কোন নড়াচড়া ছাড়া একটা ফ্যামেলি ইন্সটাম্যাটিক বা লেইকা ক্যামেরাতে পুরো রোল ছবি তুলতে পারেন : এলোমেলোভাবে এদিকে ওদিকে ক্যামেরা তাক করুন,দ্রুত এবং কোনো চিন্তা ভাবনা ছাড়াই। যখন ফিল্ম ডেভেলপ করা হবে, দেখা যাবে প্রতিটা ফ্রেমে ছবি আগেরটা থেকে ভিন্ন হবে। পরিস্থিতি আরো বাজে হবে যখন আপনি ঠাহর করবেন কিছু ছবি খানিকটা হলেও কৌতূহলোদ্দীপক। এমনকি অটোম্যাটিক ক্যামেরা যা ব্যাঙ্কে লোকজনের গতিবিধি রেকর্ড করে তাতেও ওখানকার ঘটনাঘটনের সম্পর্কটা এমন ভাবে ধরা পড়ে যা সাধারণ কোনো প্রতক্ষদর্শীকে অবাক করে।

ফটোগ্রাফারের পক্ষে চেতনাহীন ক্যামেরা যন্ত্রের দক্ষতা বা মৌলিকতার সঙ্গে পাল্লা দেয়া সহজ নয়,কিন্তু ফটোগ্রাফার তাঁর মেধা কাজে লাগাতে পারেন। ফটোগ্রাফিতে কেউ এক মিনিটে নিরানব্বই রকম অসন্তোষজনক ঘটনা-বিন্যাস বাতিল করে শততমটা বেছে নিতে পারেন। বাছাইটা হয় অন্যান্য শিল্পের মতোই  প্রথা এবং সহজাত উপলব্ধি নির্ভর, জ্ঞান আর অহং এর সমন্বয়ে। কিন্তু ছবি তোলার যে সহজসাধ্য কাজ এবং ফটোগ্রাফিতে সম্ভাবনার যে প্রাচুর্য্য, তা প্রখর সহজাত তাড়নার অধিকারীর জন্য একটা বাড়তি পাওনা। ফটোগ্রাফারের সমস্যা হয়তো অনেক বেশি জটিল যা যুক্তি দিয়ে সামলানো সম্ভব নয়। একারণেই ফটোগ্রাফাররা মটিফ নিয়ে অনিশ্চয়তা সমেত অস্থিরভাবে ঘুরঘুর করতে থাকে। অন্য কিছুর খোঁজে ব্যস্ত থাকে বলেই সামনে আগ্রহ জাগানোর মতো শক্তিশালী সব রেকর্ড উপেক্ষা করে যায়।

আমেরিকান ফটোগ্রাফার রবার্ট এ্যডামস এই ঘুরঘুর করা তরিকা এবং উদ্দেশ্য নিয়ে লিখেছেন: ‘বারবার ফটোগ্রাফার কয়েক পা হাঁটেন এবং বেশ কৌতুককর ভাবেই ক্যামেরাতে চোখ রাখেন,পরিবার এবং বন্ধুদের বিরক্তি সমেত তিনি অগনিত এ্যঙ্গেলের ছবি জড়ো করতে থাকেন। যদি প্রশ্ন করা হয় তবে ব্যাখ্যা করেন যে তিনি যুতসই একটা কম্পোজিশন বের করতে চেষ্টা করছেন। কিন্তু সেটার সংজ্ঞা দিতে বললে দ্বিধায় পড়ে যান। তিনি যা বলতে চান তা হল ফটোগ্রাফার ফর্ম চান…

ফিরিস্তি

মুনেম ওয়াসিফ ও তানজিম ওয়াহাব

 

তানজিম: এবং ট্যাবুর কিন্তু শেষ নাই যেমন কালার ফটোগ্রাফির কথা চিন্তা করেন,ছবিতে যদি কালার উজ্জ্বল না থাকে,অনুজ্জ্বল কালার হইলে সেটা কালার ছবি হইলো না। এই ধরনের ট্যাবুও কি আপনার মনে হয় না এখনো…

ওয়াসিফ: আমার কাছে মনে হয় যে এইটা আসলে খুব হাস্যকর, আমার কাছে মনে হয় মূলত এমেচার  ফটোগ্রাফারদের এই ট্রেন্ডটা বেশী থাকে। ঐ যারা একটু ক্লাব ফটোগ্রাফি করে তারা মনে করে নীল আকাশকে গাঁঢ় নীল,সবুজ ঘাসকে হলুদ ঘাস বানাইয়া দিলাম। তাইলেই হয়তো ছবিটা ইন্টারেস্টিং হইয়া গেল। কিংবা ছবিটা একটু ঘোলা ঘোলা হইলেই মনে হয় আর্ট হইয়া যায়। বাংলাদেশের আসলে ফটোগ্রাফি কি আদৌ আর্ট কি না,এ নিয়েই তো আমাদের এখনও যুদ্ধ চলতেছে,ধরেন আমাদের ঘরের ভিতরেই এখনো ফটোগ্রাফি আসলে সেই অর্থে আর্ট হিসেবে স্বীকৃত না।

তানজিম: আমিতো বলবো হ-জ-ব-র-ল অবস্থা,তবে আমি শুধু ফর্ম দিয়ে এটাকে দেখি না,আমার কাছে মনে হয় এইখানে কন্টেন্টটাও এক অর্থে গুরুত্বপূর্ণ। যেমন ধরেন আর্ট ফটোগ্রাফির যারা চর্চা করে বা আমরাই নিজেরাইতো চর্চা করি,সেখানে আর্ট ফটোগ্রাফির মানেই যেনও সুন্দর ছবি অথচ একটা সামাজিক কোন সমস্যা বিষয়ক ছবি তুললে সেটা যেনও আর্ট ফটোগ্রাফি না, সেটা যেন একটা সাংবাদিকের চোখ দিয়ে দেখা কিংবা সেটা একধরনের  ভিন্ন সোশ্যাল ডকুমেন্টারির ছকেই ফেলে দেয়া। কোনো স্ট্রাগল বা সংগ্রাম বা কোনো কিছুর মধ্যে বিমর্ষতা যেন আর্ট ফটোগ্রাফি হইতে পারে না।

ওয়াসিফ: আমাদের এইখানে এখনও আর্ট ফটোগ্রাফি মানে হচ্ছে যে কোনো জিনিসের সুন্দর দেখানো, মানে-একধরনের ঐ সুগার কোটেট ছবি তোলা আর সোশ্যাল ডকুমেন্টারি মানে হচ্ছে গরিবের দুঃখ,কষ্ট,ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট,হার্ড কন্ট্রাস্ট-এ ছবি তোলা। আমার কাছে মনে হয় দুইটাই স্টেরিও টাইপ এবং দুইটাই ক্লিশে