বেসার-মঙ্গল

আরফান আহমেদ

ছবিগুলো দেখতে কেমন জানি। কোন কিছুই নাই ছবিগুলোতে। না আছে কোন মানুষ, না আছে কোন সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য। আছে খালি বড় বড় শিল্প স্থাপনা, যেমন ব্লাস্ট ফার্নেস, ওয়াটার টাওয়ার, কুলিং টাওয়ার, গ্যাস টাওয়ার, উইন্ডিং টাওয়ার, কয়লা খনির স্থাপনা এই রকম বিদঘুটে আরও অনেক কিছু। আর কম্পোজিশন! তার তো কোন বালাই নাই। এইসব বড় বড় বিদঘুটে জিনিস ছবির একদম মাঝখানে। রুল অব থার্ড বলে যে কলা জগতে কোন কিছু বিদ্যমান আছে তা এই ছবিগুলো দেখলে বোঝা মুশকিল। আর আলো ছায়ার খেলা সে তো দূর-স্থান! সাদা কালো এই ছবিগুলোর কনট্রাস্টের কথা আর নাইবা বলি। এই রকম প্রাণহীন, মরা, গতিহীন, ব্যানাল ছবি তোলেন বের্ন্ড এবং হিলা বেসার।

সময়টা গত শতকের ষাটের দশক। প্রবল উন্মাদনায় ভরা একটা দশক। সময়ের এই উন্মাদনা এসে ধাক্কা দেয় আলোকচিত্রের দুনিয়াতেও। পুরনোকে একেবারে দুমড়ে মুচড়ে ফালি ফালি করে ছুঁড়ে ফেলেন এই প্রজন্মের আলোকচিত্রীরা। কার্তিয়ে ব্রেসো গংদের সাম্রাজ্যের উপরে নেমে আসে একের পর এক আঘাত। দার্শনিক এবং নন্দন-তাত্ত্বিক আঘাত। রবার্ট ফ্রাঙ্ক, তার গাড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়ালেন মার্কিন দেশের পুব থেকে পশ্চিম। তার ছবি হয়ে উঠল ইতিহাস, বিদ্রোহী আলোকচিত্রীদের ইশতেহার, ব্রেসোর নির্ধারণই [উত্তুঙ্গ] মুহূর্তের একচেটিয়া দাপটের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ। উইলিয়াম ক্লেইন তার ৩৫ এম.এম. লেইকা ক্যামেরা আর ওয়াইড এঙ্গেল লেন্স নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন নিউ ইয়র্কের উত্তাল রাস্তায়, প্রবল আগ্রাসী ভঙ্গী, আর বিষয়বস্তুর সাথে তার এমন উন্মত্ত বোঝাপড়া তাকে বানিয়ে তুলল যুগের প্রধান পপ ফটোগ্রাফার। আর গ্যারী উইনোর্গ্যান ছবি তুললেন ছবিতে দুনিয়া কেমন দেখায় তা দেখার জন্য, ঘোষণা করলেন আলোকচিত্র তার প্রাণের ক্ষুধা মেটায়। ডিয়ান আর্বুয সমাজের প্রান্তিক মানুষদের পোর্ট্রইেট তুললেন, তুললেন সমাজ কর্তৃক ঘোষিত অস্বাভাবিকতা, ‘বিকৃতির’ ছবি। এই উত্তাল সময়ে বের্ন্ড আর হিলা বেসার তৈরি করে নেন নিজেদের আলাদা একটা ধারা। কিন্তু দুনিয়ায় এত্ত এত্ত ছবি তোলার বিষয় থাকতে তারা দু’জন এই বিষয় নিয়ে ছবি তুললেন কেন?

বের্ন্ড আর হিলা আদতে দুই লিঙ্গের দুইজন ভিন্ন মানুষ। তারা ছবি তোলেন একই সাথে। আর ছবির মালিকানা সমানে সমানে ভাগাভাগি করে নেন। তারা দুই জনই জর্মন দেশের। হিলা পুবের আর বের্ন্ড পশ্চিমের। গত শতকের পঞ্চাশের দশকে হিলা পশ্চিম জর্মনের ডুসল্ডলফে চলে আসেন। তিনি ডুসল্ডফের কয়লা খনি, ই¯পাত কারখানা, লাইম স্টোন কারখানার স্থাপত্য শৈলী দেখে মুগ্ধ হয়ে যান। ট্রেনের জানালা থেকে এসব দেখতে দেখতে এসবের প্রেমে পড়ে যান। আর বের্ন্ড এর ছেলেবেলা কেটেছে এমনি এক শিল্পাঞ্চলে। তার পূর্ব পুরুষেরা এমন কারখানাতেই কাজ করতেন। তাদের ছবির প্রধান বিষয় উনিশ শতকের এই সমস্ত স্থাপত্য, যা ঐ সময়টাতে বিলীন হয়ে যাচ্ছিল। এই সমস্ত স্থাপনা সমূহের স্থাপত্য শৈলী একটা নির্দিষ্ট সময়ের প্রতিনিধিত্ব করে এবং সাথে সাথে অর্থনৈতিক বিকাশেরও। তাই তাদের মতে, মধ্যযুগের কোন স্থাপত্য সংরক্ষণ করা যেমন জরুরি তেমনি ভাবে এই সমস্ত শিল্প স্থাপনাগুলোও সংরক্ষণ করা জরুরি। এ কারণে তারা এই সমস্ত স্থাপনা সমূহকে ক্যামেরা বন্দী করে রাখার চেষ্টা শুরু করলেন। তাদের একটা ফক্স ভোগান ভ্যান ছিল। এই ভ্যানে করে ঘুরে বেড়াতেন আর ছবি তুলতেন। ঠিক যাযাবরের মতন, একজন হিলা তার প্রেমের জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছেন হন্যে হয়ে, আরেকজন বের্ন্ড বারে বারে ফিরে যেতে চাইছেন তার ছেলেবেলায়। ঐ ভ্যানটার ভিতরেই ছিল তাদের সংসার, ছোট একটা ডার্করুম, আর ছেলে ম্যাকশ এর জন্য ছোট্ট একটা নার্সারি।

বেসারদের ছবির দেখলে মনে হয় এদের ছবিতে কম্পোজিশনের কোন কারিগরি নাই। খুব সাধারণ বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে, কম্পোজিশন আসলেই সাদা মাটা। মূল বিষয়বস্তুর ডানে এবং বামে এবং উপরে নিচে অল্প একটু জায়গা ছেড়ে দেয়া। তাদের ওয়াটার টাওয়ার, গ্যাস টাওয়ারের ক্ষেত্রে এমনটি দেখা যায়। তাদের একটা ছবির কথাই ধরা যাক, কোন একটা জমজ পানির টাওয়ার। ছবিটি খুব স্ট্রেইট, একদম সোজাসুজি। রেইল পথের জমজ পানির টাওয়ার। বড় বড়, মোটা, প্রায় গোল দু’টি টাওয়ার। এই দু’টি টাওয়ারের সংযোগ সিঁড়িগুলো জিক-জ্যাক করে উপরের ঐ ধূসর অংশ ধরে উঁচুতে উঠে গেছে। টাওয়ার দুটির নিচে ঝোপ ঝাড়, শ্রমিকদের বাগান যা ছবির মূল বিষয়বস্তুর মাত্র এক তৃতীয়াংশ জুড়ে। আর মূল বিষয়বস্তু ছবির ঠিক মাঝখানে। কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়া। এই ছবিটির জন্য তারা অপেক্ষা করেছেন শীতকাল পর্যন্ত। যখন কুয়াশা থাকবে। এতে এই যমজ পানির টাওয়ারটার পিছনের যা কিছু আছে তা আর দেখা যাবে না, উধাও হয়ে যাবে।