স্মিথস্ক্রিয়া

তানজিম ওয়াহাব

সাইপেন দ্বীপ, আমেরিকার লাগামহীন বোমায় নাস্তা বুদ জাপানিরা। তাদের কেউ কেউ পরিবার নিয়ে গুহায় লুকিয়ে ছিল। আমেরিকানদের বোমাগুলো যেন পথ খুঁজে খুঁজে গুহাতে গিয়েই পড়ে, আর গুহা থেকে ক্রমাগত লাশ বেরিয়ে আসে। দু একজন জ্যান্ত মানুষ চোখে মৃত্যু ভয় নিয়ে ছুটতে থাকে, ছোট ছোট বাচ্চা, মা, দাদি। আমেরিকারই একজন ফটোগ্রাফার ছবিগুলো তুলতে থাকে। নিজের দেশের এই নির্বিচারে হত্যা তাকে ভয়াবহ পীড়া দেয়। কিন্তু সেতো দোটানায় পড়ে গেল। একদিক থেকে এই ছবিগুলো সেই জায়গায় তোলাটা ফটোগ্রাফার হিশাবে তার দায়িত্ব মনে হয়, আবার আরেকদিকে যুদ্ধের এই আশাহীন, নিস্তেজ ছবিগুলো তোলাটাও অর্থহীন মনে হয়। ছবি তুলতে গিয়ে এমন দ্বিধা ইউজিন স্মিথের জীবনে বারবার আসে, সমাধানও সবসময় মেলে না। কিন্তু ইউজিন ছবিটা তুলে যায়, আর ছবিগুলো বদলাতে থাকে।

সময়টা বোঝার চেষ্টা করেন। ইউজিন যখন তরুণ টগবগে যুবক, পৃথিবী তখন অনেক গরম হয়ে উঠেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দাঙ্গা, রক্ত, নির্বিচারে হত্যা। সে বারের যুদ্ধে ইউজিন নিজেও প্রচণ্ড আহত হয়, আর এরপর টানা দুই বছর বিছানায় পড়ে থাকে। বিছানার দিনগুলোতে ইউজিন জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ এক সিদ্ধান্ত নেয়, ঠিক করে যুদ্ধের আর কোন ছবি তুলবে না। হয়ত যুদ্ধের বিপরীত কোন ছবি তোলা দরকার, যেই ছবি দেখলে বাঁচতে ইচ্ছা করবে। তাই দুবছর পর প্রথম ছবিটা তুলে নিজের ছেলে-মেয়ের, বাড়ির সামনের বাগানে। বাচ্চাগুলো তুলতুলে হাত দুটো ধরে কোন এক আলোর পথে যাচ্ছে, আলোটা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেটে বের হচ্ছে, গন্তব্যটা অজানার, কিন্তু অনেক স্বপ্নের। ছবিটার নাম ওয়াক টু পেরাডাইস গার্ডেন।

ইউজিনরা বলতে চাইত জীবন ঘেঁষা গল্প, মানুষ ঘেঁষা গল্প। সংগ্রাম বা সবকিছু সামলে উঠার সাহস সঞ্চারী গল্প। তার ছবি জুড়ে অনেক কালো আর কন্ট্রাস্ট। তার ছবিতে একদিকে শোষিত, জীবন যুদ্ধে নুয়ে পড়া মানুষের দল, আর অপর দিকে না দেখা সব নায়কের এই যুদ্ধটা লড়ে যাওয়ার কাহিনী।

পেঁচালের ফাঁকে সুমনের একটা গান শুনাই। গিটারের অলস, মৃদু, টুং টাং আওয়াজ আর ভারি গলাটায় ছড়া কাটা কাটা সুর…
‘বাচ্চারা কেউ ঝামেলা করোনা উল্টো পাল্টা প্রশ্ন করোনা
চুপচাপ বসে থাক, বসে আঁক, বসে আঁক
আঁক ফুল নদী, আর প্রজাপতি, আঁক মিকি মাউস অগতির গতি
আঁক কুঁড়েঘর যদিও তোমরা পাকা বাড়িতেই থাক
এঁকো না কখনও স্বদেশের মুখ, দবড়ানো গাল ভেঙ্গে যাওয়া বুক
মর মর তার পরাণ ভোমরা…’

ঝামেলা করতে নিষেধ করা হল, অথচ ইউজিন ঝামেলা করবেই, উল্টো পাল্টা প্রশ্ন করবে, হয়ত সে চুপচাপ বসে থাকতে চায়নি। বদরাগী, ঝগড়াটে এই লোক নিজের শর্তে আপসহীন, জেদি। তার সাথে কাজ করা যে কারও জন্যই কঠিন ছিল। কোন কিছু ঠিক না মনে হলে ইউজিন কথা শোনাবে, পরিমিত থাকার প্রশ্নই ওঠে না, ঝগড়া হয়ত বাঁধবে, এরপর মুখ দেখাদেখিও বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এতসব শর্ত আর দেমাগ দেখানোর পরও মানুষ ইউজিনকে বাদ দিতে পারে নাই, তার কাজকে গ্রহণ করতে হয়েছে। দাঁড়ান, কারণগুলো আস্তে আস্তে বয়ান করার চেষ্টা করি। তার ছোটবেলা আর দশজনের মত খুব সুন্দর, সাজানো, গোছানো ছিল না। ইউজিন এর জন্ম ১৯১৮ সালে আমেরিকার কানসাসে। বাবা ছিল ছোটখাটো গমের ব্যবসায়ী, ব্যবসাতে লোকসান করে কোন এক সকালে মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে আত্মহত্যা করে সে। ইউজিন ভীষণ চমকে যায়, ব্যথা সারিয়ে উঠতে অনেকদিন সময় লাগে। ভাইয়ের পোলিও ছিল, সংসারে অভাব ছিল। কিন্তু ইউজিনের মা ছিল বেশ শক্ত, বদরাগী আর আত্মবিশ্বাসী মহিলা। মা একাই তাকে মানুষ করে। ইউজিন অনেকটাই ছিল মা ঘেঁষা, মায়ের কথার অবাধ্য হওয়ার সাহস তখনও হয়ে উঠেনি।

সেই যুদ্ধের অভিজ্ঞতার পর ইউজিন মাতে ছবির গল্পে, ছবি যেন উছিলা, আসলে ছবি দিয়ে জীবনের গল্পে পৌঁছনোর চেষ্টা। ফটো স্টোরি কিম্বা নেরেটিভ ফটোগ্রাফি নামের এক নয়া জিনিসের চল তৈরি করে। আগের মত কোন একটা ফটোতেই নন্দন চর্চা না, বরং অনেকগুলো ছবি গেঁথে গল্প বয়ান করা। সেখানে প্রতিটা ছবিরই হয়ত নিজস্ব শক্ত বুনন থাকে, কিন্তু ছবিগুলো মিলে কোরাস এর মত একসাথে কাজ করে, দলে দলে গান গায়। একই সময়ের আগে পরে জেকব রিস, এডওয়ার্ড কার্টিস, লুইস হাইনরা একই বিষয়ের অনেকগুলো ছবি তুলছে, কিন্তু গল্পের শুরু আর শেষটা ভেবে ইউজিনের মত এত গুছিয়ে ছবিতে গল্প তখনও আসেনি…