দশটি ছবি, দশটি গল্প

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………

রশীদ তালুকদার

তানজিম ওয়াহাব

পাশের ছবিটার দিকে তাকাই, চোখ সরানো যায়না, মনে লেগে থাকে। চতুর্দিকে ঘিরে থাকা ইট নামক চতর্ভূজগুলো শক্তিশালী জ্যামিতিক বিন্যাস তৈরি করে আর ইট, পানি, কাদার চক্রাকার ঘূর্ণনের প্রায় মাঝখানে মাথাটা আঁটা। ছায়াবিষ্ট কালচে অংশগুলো নাটকীয়ভাবে শঙ্কা তৈরি করে। এত শক্তিশালী কম্পোজিশন রশিদের দীর্ঘকাল সালন ফটোগ্রাফি চর্চার প্রতিফলন, যা সেই সময়ের এদেশের অন্য ফটো সাংবাদিকদের থেকে ছবিগুলো আলাদা করে। আবার ছবিটা কিন্তু অনেক শীতল। কোন চিৎকার করে ওঠেনা। নিঃশব্দ, সংযত…

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..

শহীদুল আলম

মুনেম ওয়াসিফ

গল্পটি রাজনৈতিক। কাজটি শুরু করেছিলেন ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর। কিন্তু সেখানে কেবল তিনি মিছিল বা বন্যার নিউজ মার্কা ছবি দিয়ে থেমে যাননি। বুনলেন অন্য গল্প। একদিকে রাখলেন বন্যায় না খেতে পাওয়া অপেক্ষারত শিশুদের ছবি অন্য দিকে মন্ত্রীর বাড়ির বিয়ের উৎসব, দুই জায়গায় থরে থরে মানুষ। শ্রেণী বৈষম্য। ছবিতে ছবিতে যোগাযোগ স্থাপিত হল। দেখালেন সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবন, পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাদের অবস্থান (তথা আদিবাসী নির্যাতন), ডলার আর টাকার থৈ থৈ করা চিংড়ি ঘেরের মাঝে ক্ষুধার্ত গরু, সর্বশেষে এরশাদের পতনে মানুষের উল্লাস। সাথে একটি খোলা চিঠি, দেশের প্রধানমন্ত্রীকে লেখা। লেখাগুলো যেন ছবির অংশ হয়ে উঠল…

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..

সাইদা খানম

তানজিম ওয়াহাব

তরুণী মেয়েটির কাঁধে ঝোলা, নিজ পাড়ায় ক্যামেরাটা লুকোতে হয়, পথে দাঁড়ানো লোকগুলোর আজেবাজে কথা কানে বাজে, কখনও সখনও মাথায় ঢিলও এসে জুটে। তার ছবি তোলাটা কতটুকু দরকার ছিল জানিনা, যখন পুরুষের এই সমাজে সময়টা ছিল অস্থির, মেয়েদের হাতে ক্যামেরাটা ধরারও সাহস নাই। তারপরও ছবিই বাদলকে টানে, বাদল নিয়ন্ত্রণ হারায়, ক্যামেরাটা আর ছাড়া হয়না। এভাবেই ষাটের দশকের কোন এক বিকেলে বাদল ছবি তুলেছে। ছবিতে দেখি বান্ধবী গুলনেহার, আলেয়া আর নাজমাকে নিয়ে বাদলের বেড়াতে যাওয়া, বুড়িগঙ্গার গা ঘেঁষে রূপমহল নামের পুরনো এক দালান, বিকেলের আলোয় রূপমহলের রূপসী দেয়ালের চোখ ধাঁধানো কারুকাজ, পুরনো দেয়াল জুড়ে ফাটা প্লাস্টারের ক্ষত, খাড়া পিলারগুলোর মত শান্ত সোজা লম্বাভাবে দাঁড়ানো শাড়ি পড়া ছিপছিপে গড়নের তিনজন তরুণী, যাদের মাঝের জন উল্টো দিকে ঘুরে রেলিংয়ে ঠেস দিয়ে কোথায় যেন হারিয়ে যায়।

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..

শেহজাদ নূরানি

মুনেম ওয়াসিফ

ধরা যাক মেরি এলেন মার্ক এর বম্বের ফকল্যান্ড রোডের ছবিগুলোর কথা; একদম কাছ থেকে দেখা, যেখানে কোন দ্বিধা নেই, কোন সংকোচ নেই, একদম খুল্লাম খুল্লা, রগরগে সেক্সের ছবি! কিন্তু এতটা কাছে যাওয়াও কি নৈতিক, যদি না হয় তাহলে ফটোগ্রাফার সীমানাটা টানবে কোথায়? নাকি নৈতিকতার ধারণাটি সেকেলে! ফটোগ্রাফাররা কি তাহলে লুকিয়ে লুকিয়ে ছবি তুলে যাবেন? বিড়ালের মত পা টিপে টিপে, নিঃশব্দে; কেউ বোঝার আগেই মাছ নিয়ে দৌড়! তাহলে কি ফটোগ্রাফাররা চোর! মানুষের ভিতরের, ব্যক্তিগত, গোপন মুহূর্তগুলো চুরি করে বেড়ায়? আবার কাছে না গেলে ওদের জীবনের গল্পটা বলবে কি করে? এখানে দূরত্বটা কি শারীরিক না মানসিক? রবার্ট কাপা ‘ক্লোজনেস’ বলতে কি বুঝিয়েছেন তাহলে? আমরা বিষয়কে জানিয়ে ছবি তুলি তাহলে কাজটা অনেক সৎ হয়, আচ্ছা সৎ হয়ে ওদের জানিয়ে ছবি তোলা হল, ওদের সাথে খাওয়া-ঘুম সব হল, ফটোগ্রাফার ওদের ভাই কিংবা বোনের মত হয়ে গেল, তারপর ছবিগুলো দিয়ে কি করা হবে…

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..

শফিকুল আলম কিরণ

তানজিম ওয়াহাব

মজেদার স্বামীরই হয়ত এই ছবিটা তোলার কথা ছিল, কিন্তু যৌতুক না পেয়ে আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা মাজেদাকে এসিড মেরে পালায় সে। অন্ধ মজেদার স্বপ্নে শিশুটার চেহারা নির্মাণ আর বিনির্মাণ হতে থাকবে। আসল চেহারাটা দেখা সম্ভব নয়। হাসপাতালে ছবিটা তুলে ডকুমেন্টারি ফটোগ্রাফার কিরণ। খুব কাছে গিয়ে তোলা ছবি। কিরণ একজন পুরুষ, মাজেদার পক্ষে কি আর কোন পুরুষকে বিশ্বাস করা সম্ভব? এই কাজের অন্য ছবিগুলোতে খুব কাছ থেকে এই মানুষগুলোর কিছু ব্যক্তিগত আবেগ আর উচ্ছ্বাসের মুহূর্ত দেখা যায়, কিরণ কিছুটা হলেও বিশ্বাস তৈরি করে নেয়। পাশের ছবিটা বেশ সরাসরি, ফিল ফ্লাশে বাড়তি আলো দেয়, যাতে মুখ, ভঙ্গি, মুখের ভাঁজ, আবেগ, গোটাটাই দেখা যায়। দূরে দাঁড়িয়ে সতর্ক হয়ে কম্পোজিশনে কোন ফর্ম ধরার চেষ্টা নেই, ডজ বার্ন এর বিশেষ কেরামতি নেই।

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..

পারিবারিক ছবি

মুনেম ওয়াসিফ

ব্যর্থতার দায় ঘুচাতে গিয়ে ভাবতে শুরু করি কেন এদের ছবি আমার প্রাণ ছোঁয় না। তার একটা বড় কারণ ধারণা করি ফটোগ্রাফি সম্পর্কে আমার আদিম জ্ঞান। যেখান থেকে আমি একটি ছবিকে ব্যবচ্ছেদ করতে শিখেছি, একদম টুকরো টুকরো করে, নির্মোহ ভাবে। তার লাইন, ফর্ম, ব্যাকরণ, জ্যামিতিক কাঠামো দ্বারা। ছবির আবেগ,অবস্থান আর রাজনীতি তো পরের কথা। এদিকে ফেসবুক, ফ্লিকার, আর ইন্টারনেটে খালি লাইকের পরে লাইক। কিন্তু এই গণ-ছবিগুলো বড্ড পানসে লাগে, মগবাজারের সস্তা হোটেলের ভেজিটেবেলের মত। কোনও গন্ধ, স্বাদ কিংবা আলাদা মোচড় নাই, সবই যান্ত্রিক পুনরুৎপাদন। আর যারা ফটোগ্রাফি (ব্যাকরণ) জেনে করেন, তাদের অনেকের ছবি আরও খারাপ। সবই মুখস্থ, প্রি-কম্পোসড, মিথ্যা ভণিতা—মধ্যবিত্ত মূল্যবোধের মত। একটু সাইড লাইটের কেরদানি, ফরমের নৃত্য আর ফটোশপের ডজবাজি দিয়ে ছবি হয় না। বিস্বাদ লাগে!

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
আজিজুর রহীম পিউ
তানজিম ওয়াহাব

টানটান উত্তেজনা! সময়ের আগে তাদের দৌড়াতে হয়। চোখে সানগ্লাস, পিঠে ক্যামেরার ব্যাগ, শরীরে ছড়ানো অনেকগুলো পকেট আর প্যাঁচ দিয়ে থাকা যন্ত্রপাতি-ক্যামেরা, ফ্লাশ, ফিল্ম। ভালই ভাবসাব! দুপুর বেলায় ঢাকা ভার্সিটি টিএসসির সামনে অনেকগুলো মোটর সাইকেল গায়ে গায়ে লেগে থাকে আর পাশে চায়ের টঙে আড্ডা চলে। তারা এই আছে, এই নাই। হঠাৎ ফোন বাজলেই বাইকটা চেপে দে ছুট। প্রচণ্ড গরম আর টেনশনে ঘেমে গোছল, রাস্তা জুড়ে ট্রাফিক জ্যাম, হর্নের কর্কশ ভোঁ ভোঁ শব্দ। ঘটনায় হাজির হওয়ার সাথে সাথেই বাকিদের ভীড়, কুস্তি লড়তে হয়, কনুই মেরে সামনে আসতে হয়। ফলাফলে কেউ ক্যামেরাটা ভেঙ্গে দিতে পারে, শার্টের কলার টেনে সজোরে কিল ঘুসি খাওয়াও সম্ভব। যত কিছুই হোক সবার আগেই সামনে গিয়ে ছবিটা পাওয়া লাগবেই, এডিটর সাহেব সেটাই চায়। বিদেশের প্রেস ফটোগ্রাফির সাথে তুলনা করলে এদেশের অবস্থা অনেক শোচনীয়, যেখানে পত্রিকায় একজন ফটো এডিটরের পদ নাই, কারও ভাল ছবি বোঝার বালাই নাই, ছাপানো ছবিতে ফটোগ্রাফারের নাম নাই, বেতন নাই, ভাল ক্যামেরা নাই। সবকিছু জেনেও তারা ছুটে।

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..

জি এম বি আকাশ

মুনেম ওয়াসিফ

তত দিনে যা হবার তাই হয়ে গেছে। প্রথমে শহিদুল তারপর শেহজাদ, আবির, কিরণ—একের পর এক দুর্ধর্ষ কাজ। সব হার্ড কোর ব্ল্যাক অ্যান্ড ওয়াইট আর মানবিক মুহূর্তের ছবি। আকাশও শুরু করেছিলেন সেই ঘরানাতেই। অদ্ভুত মায়া ছিল ছবিগুলির মধ্যে। সমুদ্র পাড়ে উদাসী চালক আর ক্লান্ত ঘোড়া অথবা মায়ের হাতে তার বৃদ্ধ দাদাকে স্নান করানোর আন্তরিক দৃশ্য। প্রথম দিকের সাদাকালো কাজে আমরা সেই পুরনো ছবির ছায়াই দেখতে পাই। এমনিতে নতুন ফটোগ্রাফারদের উপর অনেক চাপ। ঘাড় সোজা করে দাঁড়ানো কঠিন। পুরনো কাঠামো ঝেড়ে ফেলা সহজ নয়। আবার নতুন ভাষা না হলে নতুন গল্পও বলা যাচ্ছে না। নিঃশ্বাস নেওয়াটাই যেন কষ্টকর।

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..

রাসেল চৌধুরী

তানজিম ওয়াহাব

এর আগে বুড়িগঙ্গার দুরকম ছবি দেখেছি। এক ধরনের ছবি হল নৈসর্গিক কোন দৃশ্য। নিভ নিভ সন্ধ্যার আলোয় মস্ত বড় সূর্যটা ডুবে, আকাশ জুড়ে মেঘের খেলা আর পানিতে মোশন ব্লারে ঝাপসা নৌকোগুলোর মাছির মত ছুটাছুটি। আরেক রকম ছবি হল হালের বুড়িগঙ্গায় কালচে পানির বোতল, আবর্জনা, বুদবুদ আর পাশে বা পেছনে ময়লা স্তূপ করে রাখা। দূষণের ছবি, হয়ত তা ব্যবহার হবে এনজিও’র পরিবেশ রক্ষার পোস্টারে।

পাশের ছবিটা এই দুইয়ের কোনটার দলে পড়ে না। ছবিতে পাওয়া যায় খুব ফ্যাকাসে, মরা এক আলো, সাদাতে আকাশে মেঘের কোন ডিটেল নাই, উজ্জ্বল কোন রঙ নাই, চোখ ধাঁধানো নন্দন নাই। নাটকের যেন বড়ই অভাব। ফটোগ্রাফার কি নাটকীয় ছবি তুলতে পারেনা? নাকি সে সেরকম ছবি আর তুলতে চায় না?

 

সাতটি ছবি সাতটি গল্প

…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..

আমানুল হক

তানজিম ওয়াহাব

আমানুল-এর কেনা চোরাবাজারের সেকেন্ড হ্যান্ড জাপানী ক্যামেরা, তার কুঁজো, রোগা শরীরের ছিপছিপে গড়ন, খুব সাধারণ ঢিলে হাতা খদ্দরের পাঞ্জাবি, পায়জামা আর চপ্পল, মৃদু কণ্ঠের পরিমিত আলাপচারীতার সাথে ছবিটি মেলানোর চেষ্টা করছি। রীতিমত হিমশিম খাচ্ছি। শক্তিশালী কম্পোজিশন। দু’হাত মেলে দিয়ে দানবীয় ভঙ্গিতে এক মানব শরীর। পেছন থেকে তোলা, চেহারা দেখা যায় না, তবে আসল চেহারাটা অনুভূত হয়। ছবির মানুষটি নিয়ে একটু পরেই বলি, ছবির পেছনের যে মানুষ …

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….

নাইব উদ্দিন আহমেদ

মুনেম ওয়াসিফ

কিন্তু ছবি তোলা হলেই তো হবে না, সেই নেগেটিভ ধোলাই করা থেকে প্রিন্ট তৈরি পর্যন্ত সব কাজ তিনি নিজের হাতে করতেন। অন্ধকার ঘর, টেবিলের চারপাশে কাঁথা মুড়ানো আর হারিকেনের লাল সেলোফেন থেকে আসা আলতো আলো দিয়ে চলত ডার্করুমের কাজ। পানির ভিতর থেকে একটি সাদা কাগজ। লাল আলো। তার ভিতর থেকে আস্তে আস্তে ছবি বেরিয়ে আসতে দেখার যে কি প্রবল উত্তেজনা, তা এই প্রজন্মের অনেক আলোকচিত্রি বুঝবে না …

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….

ড: নওয়াজেশ আহমেদ

তানজিম ওয়াহাব

ছুটি পেয়ে রবীন্দ্রনাথের ফুলবাগানের ফুলগুলো অসংযত উচ্চহাসি দিলেও নওয়াজেশের ছবিতে তারা সম্পূর্ণ উল্টো ভঙ্গিতে। এখানে তারা প্রচণ্ড সংযত, পরিপাটিভাবে ফুলদানিতে সাজানো। এলোমেলোভাবে হেলাদোলার বদলে প্রচণ্ড স্থির, ঠাণ্ডা।  চৈত্রের পড়ন্ত রোদ তাদের পিঠে এসে না পড়লেও জানালার ফাঁক দিয়ে আলতোভাবে ছুঁয়ে যাচ্ছে। বাঁকাপথে আসার সময় কুঁচি কুঁচি হয়ে আলো কেটে আসছে জানালার গ্রিল থেকে …

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….

আনোয়ার হোসেন

মুনেম ওয়াসিফ

আমরা এখানে মায়া, আনোয়ার হোসেন, তাদের ঘর কিংবা আর কিছু দেখতে পাই না। কেবল একটি হাত, কাঁচি, সুতো আর সুই। এতো অল্পে কিভাবে জীবনের গল্প হয়ে যায়! এভাবেই আনোয়ার হোসেন মরা পাখি, স্যান্ডেল, পুরানো কাঁচি, তাবিজ, পানের ডিব্বা, কিংবা প্রিয় মানুষের শরীরের অংশবিশেষ নিয়ে এসেছেন তার এই কাজে। সরল, পরিমিত, স্বচ্ছ অথচ ছবিগুলো জার্মান টাইপোলজির মতো আবেগহীন নয়। এইগুলো আনোয়ার হোসেনের বেড়ে উঠার আখ্যান, একেকটি সাংকেতিক গল্প।