স্মিথস্ক্রিয়া

তানজিম ওয়াহাব

সাইপেন দ্বীপ, আমেরিকার লাগামহীন বোমায় নাস্তা বুদ জাপানিরা। তাদের কেউ কেউ পরিবার নিয়ে গুহায় লুকিয়ে ছিল। আমেরিকানদের বোমাগুলো যেন পথ খুঁজে খুঁজে গুহাতে গিয়েই পড়ে, আর গুহা থেকে ক্রমাগত লাশ বেরিয়ে আসে। দু একজন জ্যান্ত মানুষ চোখে মৃত্যু ভয় নিয়ে ছুটতে থাকে, ছোট ছোট বাচ্চা, মা, দাদি। আমেরিকারই একজন ফটোগ্রাফার ছবিগুলো তুলতে থাকে। নিজের দেশের এই নির্বিচারে হত্যা তাকে ভয়াবহ পীড়া দেয়। কিন্তু সেতো দোটানায় পড়ে গেল। একদিক থেকে এই ছবিগুলো সেই জায়গায় তোলাটা ফটোগ্রাফার হিশাবে তার দায়িত্ব মনে হয়, আবার আরেকদিকে যুদ্ধের এই আশাহীন, নিস্তেজ ছবিগুলো তোলাটাও অর্থহীন মনে হয়। ছবি তুলতে গিয়ে এমন দ্বিধা ইউজিন স্মিথের জীবনে বারবার আসে, সমাধানও সবসময় মেলে না। কিন্তু ইউজিন ছবিটা তুলে যায়, আর ছবিগুলো বদলাতে থাকে।

সময়টা বোঝার চেষ্টা করেন। ইউজিন যখন তরুণ টগবগে যুবক, পৃথিবী তখন অনেক গরম হয়ে উঠেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দাঙ্গা, রক্ত, নির্বিচারে হত্যা। সে বারের যুদ্ধে ইউজিন নিজেও প্রচণ্ড আহত হয়, আর এরপর টানা দুই বছর বিছানায় পড়ে থাকে। বিছানার দিনগুলোতে ইউজিন জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ এক সিদ্ধান্ত নেয়, ঠিক করে যুদ্ধের আর কোন ছবি তুলবে না। হয়ত যুদ্ধের বিপরীত কোন ছবি তোলা দরকার, যেই ছবি দেখলে বাঁচতে ইচ্ছা করবে। তাই দুবছর পর প্রথম ছবিটা তুলে নিজের ছেলে-মেয়ের, বাড়ির সামনের বাগানে। বাচ্চাগুলো তুলতুলে হাত দুটো ধরে কোন এক আলোর পথে যাচ্ছে, আলোটা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেটে বের হচ্ছে, গন্তব্যটা অজানার, কিন্তু অনেক স্বপ্নের। ছবিটার নাম ওয়াক টু পেরাডাইস গার্ডেন।

ইউজিনরা বলতে চাইত জীবন ঘেঁষা গল্প, মানুষ ঘেঁষা গল্প। সংগ্রাম বা সবকিছু সামলে উঠার সাহস সঞ্চারী গল্প। তার ছবি জুড়ে অনেক কালো আর কন্ট্রাস্ট। তার ছবিতে একদিকে শোষিত, জীবন যুদ্ধে নুয়ে পড়া মানুষের দল, আর অপর দিকে না দেখা সব নায়কের এই যুদ্ধটা লড়ে যাওয়ার কাহিনী।

পেঁচালের ফাঁকে সুমনের একটা গান শুনাই। গিটারের অলস, মৃদু, টুং টাং আওয়াজ আর ভারি গলাটায় ছড়া কাটা কাটা সুর…
‘বাচ্চারা কেউ ঝামেলা করোনা উল্টো পাল্টা প্রশ্ন করোনা
চুপচাপ বসে থাক, বসে আঁক, বসে আঁক
আঁক ফুল নদী, আর প্রজাপতি, আঁক মিকি মাউস অগতির গতি
আঁক কুঁড়েঘর যদিও তোমরা পাকা বাড়িতেই থাক
এঁকো না কখনও স্বদেশের মুখ, দবড়ানো গাল ভেঙ্গে যাওয়া বুক
মর মর তার পরাণ ভোমরা…’

ঝামেলা করতে নিষেধ করা হল, অথচ ইউজিন ঝামেলা করবেই, উল্টো পাল্টা প্রশ্ন করবে, হয়ত সে চুপচাপ বসে থাকতে চায়নি। বদরাগী, ঝগড়াটে এই লোক নিজের শর্তে আপসহীন, জেদি। তার সাথে কাজ করা যে কারও জন্যই কঠিন ছিল। কোন কিছু ঠিক না মনে হলে ইউজিন কথা শোনাবে, পরিমিত থাকার প্রশ্নই ওঠে না, ঝগড়া হয়ত বাঁধবে, এরপর মুখ দেখাদেখিও বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এতসব শর্ত আর দেমাগ দেখানোর পরও মানুষ ইউজিনকে বাদ দিতে পারে নাই, তার কাজকে গ্রহণ করতে হয়েছে। দাঁড়ান, কারণগুলো আস্তে আস্তে বয়ান করার চেষ্টা করি। তার ছোটবেলা আর দশজনের মত খুব সুন্দর, সাজানো, গোছানো ছিল না। ইউজিন এর জন্ম ১৯১৮ সালে আমেরিকার কানসাসে। বাবা ছিল ছোটখাটো গমের ব্যবসায়ী, ব্যবসাতে লোকসান করে কোন এক সকালে মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে আত্মহত্যা করে সে। ইউজিন ভীষণ চমকে যায়, ব্যথা সারিয়ে উঠতে অনেকদিন সময় লাগে। ভাইয়ের পোলিও ছিল, সংসারে অভাব ছিল। কিন্তু ইউজিনের মা ছিল বেশ শক্ত, বদরাগী আর আত্মবিশ্বাসী মহিলা। মা একাই তাকে মানুষ করে। ইউজিন অনেকটাই ছিল মা ঘেঁষা, মায়ের কথার অবাধ্য হওয়ার সাহস তখনও হয়ে উঠেনি।

সেই যুদ্ধের অভিজ্ঞতার পর ইউজিন মাতে ছবির গল্পে, ছবি যেন উছিলা, আসলে ছবি দিয়ে জীবনের গল্পে পৌঁছনোর চেষ্টা। ফটো স্টোরি কিম্বা নেরেটিভ ফটোগ্রাফি নামের এক নয়া জিনিসের চল তৈরি করে। আগের মত কোন একটা ফটোতেই নন্দন চর্চা না, বরং অনেকগুলো ছবি গেঁথে গল্প বয়ান করা। সেখানে প্রতিটা ছবিরই হয়ত নিজস্ব শক্ত বুনন থাকে, কিন্তু ছবিগুলো মিলে কোরাস এর মত একসাথে কাজ করে, দলে দলে গান গায়। একই সময়ের আগে পরে জেকব রিস, এডওয়ার্ড কার্টিস, লুইস হাইনরা একই বিষয়ের অনেকগুলো ছবি তুলছে, কিন্তু গল্পের শুরু আর শেষটা ভেবে ইউজিনের মত এত গুছিয়ে ছবিতে গল্প তখনও আসেনি…

দশটি ছবি, দশটি গল্প

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………

রশীদ তালুকদার

তানজিম ওয়াহাব

পাশের ছবিটার দিকে তাকাই, চোখ সরানো যায়না, মনে লেগে থাকে। চতুর্দিকে ঘিরে থাকা ইট নামক চতর্ভূজগুলো শক্তিশালী জ্যামিতিক বিন্যাস তৈরি করে আর ইট, পানি, কাদার চক্রাকার ঘূর্ণনের প্রায় মাঝখানে মাথাটা আঁটা। ছায়াবিষ্ট কালচে অংশগুলো নাটকীয়ভাবে শঙ্কা তৈরি করে। এত শক্তিশালী কম্পোজিশন রশিদের দীর্ঘকাল সালন ফটোগ্রাফি চর্চার প্রতিফলন, যা সেই সময়ের এদেশের অন্য ফটো সাংবাদিকদের থেকে ছবিগুলো আলাদা করে। আবার ছবিটা কিন্তু অনেক শীতল। কোন চিৎকার করে ওঠেনা। নিঃশব্দ, সংযত…

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..

শহীদুল আলম

মুনেম ওয়াসিফ

গল্পটি রাজনৈতিক। কাজটি শুরু করেছিলেন ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর। কিন্তু সেখানে কেবল তিনি মিছিল বা বন্যার নিউজ মার্কা ছবি দিয়ে থেমে যাননি। বুনলেন অন্য গল্প। একদিকে রাখলেন বন্যায় না খেতে পাওয়া অপেক্ষারত শিশুদের ছবি অন্য দিকে মন্ত্রীর বাড়ির বিয়ের উৎসব, দুই জায়গায় থরে থরে মানুষ। শ্রেণী বৈষম্য। ছবিতে ছবিতে যোগাযোগ স্থাপিত হল। দেখালেন সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবন, পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাদের অবস্থান (তথা আদিবাসী নির্যাতন), ডলার আর টাকার থৈ থৈ করা চিংড়ি ঘেরের মাঝে ক্ষুধার্ত গরু, সর্বশেষে এরশাদের পতনে মানুষের উল্লাস। সাথে একটি খোলা চিঠি, দেশের প্রধানমন্ত্রীকে লেখা। লেখাগুলো যেন ছবির অংশ হয়ে উঠল…

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..

সাইদা খানম

তানজিম ওয়াহাব

তরুণী মেয়েটির কাঁধে ঝোলা, নিজ পাড়ায় ক্যামেরাটা লুকোতে হয়, পথে দাঁড়ানো লোকগুলোর আজেবাজে কথা কানে বাজে, কখনও সখনও মাথায় ঢিলও এসে জুটে। তার ছবি তোলাটা কতটুকু দরকার ছিল জানিনা, যখন পুরুষের এই সমাজে সময়টা ছিল অস্থির, মেয়েদের হাতে ক্যামেরাটা ধরারও সাহস নাই। তারপরও ছবিই বাদলকে টানে, বাদল নিয়ন্ত্রণ হারায়, ক্যামেরাটা আর ছাড়া হয়না। এভাবেই ষাটের দশকের কোন এক বিকেলে বাদল ছবি তুলেছে। ছবিতে দেখি বান্ধবী গুলনেহার, আলেয়া আর নাজমাকে নিয়ে বাদলের বেড়াতে যাওয়া, বুড়িগঙ্গার গা ঘেঁষে রূপমহল নামের পুরনো এক দালান, বিকেলের আলোয় রূপমহলের রূপসী দেয়ালের চোখ ধাঁধানো কারুকাজ, পুরনো দেয়াল জুড়ে ফাটা প্লাস্টারের ক্ষত, খাড়া পিলারগুলোর মত শান্ত সোজা লম্বাভাবে দাঁড়ানো শাড়ি পড়া ছিপছিপে গড়নের তিনজন তরুণী, যাদের মাঝের জন উল্টো দিকে ঘুরে রেলিংয়ে ঠেস দিয়ে কোথায় যেন হারিয়ে যায়।

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..

শেহজাদ নূরানি

মুনেম ওয়াসিফ

ধরা যাক মেরি এলেন মার্ক এর বম্বের ফকল্যান্ড রোডের ছবিগুলোর কথা; একদম কাছ থেকে দেখা, যেখানে কোন দ্বিধা নেই, কোন সংকোচ নেই, একদম খুল্লাম খুল্লা, রগরগে সেক্সের ছবি! কিন্তু এতটা কাছে যাওয়াও কি নৈতিক, যদি না হয় তাহলে ফটোগ্রাফার সীমানাটা টানবে কোথায়? নাকি নৈতিকতার ধারণাটি সেকেলে! ফটোগ্রাফাররা কি তাহলে লুকিয়ে লুকিয়ে ছবি তুলে যাবেন? বিড়ালের মত পা টিপে টিপে, নিঃশব্দে; কেউ বোঝার আগেই মাছ নিয়ে দৌড়! তাহলে কি ফটোগ্রাফাররা চোর! মানুষের ভিতরের, ব্যক্তিগত, গোপন মুহূর্তগুলো চুরি করে বেড়ায়? আবার কাছে না গেলে ওদের জীবনের গল্পটা বলবে কি করে? এখানে দূরত্বটা কি শারীরিক না মানসিক? রবার্ট কাপা ‘ক্লোজনেস’ বলতে কি বুঝিয়েছেন তাহলে? আমরা বিষয়কে জানিয়ে ছবি তুলি তাহলে কাজটা অনেক সৎ হয়, আচ্ছা সৎ হয়ে ওদের জানিয়ে ছবি তোলা হল, ওদের সাথে খাওয়া-ঘুম সব হল, ফটোগ্রাফার ওদের ভাই কিংবা বোনের মত হয়ে গেল, তারপর ছবিগুলো দিয়ে কি করা হবে…

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..

শফিকুল আলম কিরণ

তানজিম ওয়াহাব

মজেদার স্বামীরই হয়ত এই ছবিটা তোলার কথা ছিল, কিন্তু যৌতুক না পেয়ে আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা মাজেদাকে এসিড মেরে পালায় সে। অন্ধ মজেদার স্বপ্নে শিশুটার চেহারা নির্মাণ আর বিনির্মাণ হতে থাকবে। আসল চেহারাটা দেখা সম্ভব নয়। হাসপাতালে ছবিটা তুলে ডকুমেন্টারি ফটোগ্রাফার কিরণ। খুব কাছে গিয়ে তোলা ছবি। কিরণ একজন পুরুষ, মাজেদার পক্ষে কি আর কোন পুরুষকে বিশ্বাস করা সম্ভব? এই কাজের অন্য ছবিগুলোতে খুব কাছ থেকে এই মানুষগুলোর কিছু ব্যক্তিগত আবেগ আর উচ্ছ্বাসের মুহূর্ত দেখা যায়, কিরণ কিছুটা হলেও বিশ্বাস তৈরি করে নেয়। পাশের ছবিটা বেশ সরাসরি, ফিল ফ্লাশে বাড়তি আলো দেয়, যাতে মুখ, ভঙ্গি, মুখের ভাঁজ, আবেগ, গোটাটাই দেখা যায়। দূরে দাঁড়িয়ে সতর্ক হয়ে কম্পোজিশনে কোন ফর্ম ধরার চেষ্টা নেই, ডজ বার্ন এর বিশেষ কেরামতি নেই।

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..

পারিবারিক ছবি

মুনেম ওয়াসিফ

ব্যর্থতার দায় ঘুচাতে গিয়ে ভাবতে শুরু করি কেন এদের ছবি আমার প্রাণ ছোঁয় না। তার একটা বড় কারণ ধারণা করি ফটোগ্রাফি সম্পর্কে আমার আদিম জ্ঞান। যেখান থেকে আমি একটি ছবিকে ব্যবচ্ছেদ করতে শিখেছি, একদম টুকরো টুকরো করে, নির্মোহ ভাবে। তার লাইন, ফর্ম, ব্যাকরণ, জ্যামিতিক কাঠামো দ্বারা। ছবির আবেগ,অবস্থান আর রাজনীতি তো পরের কথা। এদিকে ফেসবুক, ফ্লিকার, আর ইন্টারনেটে খালি লাইকের পরে লাইক। কিন্তু এই গণ-ছবিগুলো বড্ড পানসে লাগে, মগবাজারের সস্তা হোটেলের ভেজিটেবেলের মত। কোনও গন্ধ, স্বাদ কিংবা আলাদা মোচড় নাই, সবই যান্ত্রিক পুনরুৎপাদন। আর যারা ফটোগ্রাফি (ব্যাকরণ) জেনে করেন, তাদের অনেকের ছবি আরও খারাপ। সবই মুখস্থ, প্রি-কম্পোসড, মিথ্যা ভণিতা—মধ্যবিত্ত মূল্যবোধের মত। একটু সাইড লাইটের কেরদানি, ফরমের নৃত্য আর ফটোশপের ডজবাজি দিয়ে ছবি হয় না। বিস্বাদ লাগে!

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
আজিজুর রহীম পিউ
তানজিম ওয়াহাব

টানটান উত্তেজনা! সময়ের আগে তাদের দৌড়াতে হয়। চোখে সানগ্লাস, পিঠে ক্যামেরার ব্যাগ, শরীরে ছড়ানো অনেকগুলো পকেট আর প্যাঁচ দিয়ে থাকা যন্ত্রপাতি-ক্যামেরা, ফ্লাশ, ফিল্ম। ভালই ভাবসাব! দুপুর বেলায় ঢাকা ভার্সিটি টিএসসির সামনে অনেকগুলো মোটর সাইকেল গায়ে গায়ে লেগে থাকে আর পাশে চায়ের টঙে আড্ডা চলে। তারা এই আছে, এই নাই। হঠাৎ ফোন বাজলেই বাইকটা চেপে দে ছুট। প্রচণ্ড গরম আর টেনশনে ঘেমে গোছল, রাস্তা জুড়ে ট্রাফিক জ্যাম, হর্নের কর্কশ ভোঁ ভোঁ শব্দ। ঘটনায় হাজির হওয়ার সাথে সাথেই বাকিদের ভীড়, কুস্তি লড়তে হয়, কনুই মেরে সামনে আসতে হয়। ফলাফলে কেউ ক্যামেরাটা ভেঙ্গে দিতে পারে, শার্টের কলার টেনে সজোরে কিল ঘুসি খাওয়াও সম্ভব। যত কিছুই হোক সবার আগেই সামনে গিয়ে ছবিটা পাওয়া লাগবেই, এডিটর সাহেব সেটাই চায়। বিদেশের প্রেস ফটোগ্রাফির সাথে তুলনা করলে এদেশের অবস্থা অনেক শোচনীয়, যেখানে পত্রিকায় একজন ফটো এডিটরের পদ নাই, কারও ভাল ছবি বোঝার বালাই নাই, ছাপানো ছবিতে ফটোগ্রাফারের নাম নাই, বেতন নাই, ভাল ক্যামেরা নাই। সবকিছু জেনেও তারা ছুটে।

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..

জি এম বি আকাশ

মুনেম ওয়াসিফ

তত দিনে যা হবার তাই হয়ে গেছে। প্রথমে শহিদুল তারপর শেহজাদ, আবির, কিরণ—একের পর এক দুর্ধর্ষ কাজ। সব হার্ড কোর ব্ল্যাক অ্যান্ড ওয়াইট আর মানবিক মুহূর্তের ছবি। আকাশও শুরু করেছিলেন সেই ঘরানাতেই। অদ্ভুত মায়া ছিল ছবিগুলির মধ্যে। সমুদ্র পাড়ে উদাসী চালক আর ক্লান্ত ঘোড়া অথবা মায়ের হাতে তার বৃদ্ধ দাদাকে স্নান করানোর আন্তরিক দৃশ্য। প্রথম দিকের সাদাকালো কাজে আমরা সেই পুরনো ছবির ছায়াই দেখতে পাই। এমনিতে নতুন ফটোগ্রাফারদের উপর অনেক চাপ। ঘাড় সোজা করে দাঁড়ানো কঠিন। পুরনো কাঠামো ঝেড়ে ফেলা সহজ নয়। আবার নতুন ভাষা না হলে নতুন গল্পও বলা যাচ্ছে না। নিঃশ্বাস নেওয়াটাই যেন কষ্টকর।

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..

রাসেল চৌধুরী

তানজিম ওয়াহাব

এর আগে বুড়িগঙ্গার দুরকম ছবি দেখেছি। এক ধরনের ছবি হল নৈসর্গিক কোন দৃশ্য। নিভ নিভ সন্ধ্যার আলোয় মস্ত বড় সূর্যটা ডুবে, আকাশ জুড়ে মেঘের খেলা আর পানিতে মোশন ব্লারে ঝাপসা নৌকোগুলোর মাছির মত ছুটাছুটি। আরেক রকম ছবি হল হালের বুড়িগঙ্গায় কালচে পানির বোতল, আবর্জনা, বুদবুদ আর পাশে বা পেছনে ময়লা স্তূপ করে রাখা। দূষণের ছবি, হয়ত তা ব্যবহার হবে এনজিও’র পরিবেশ রক্ষার পোস্টারে।

পাশের ছবিটা এই দুইয়ের কোনটার দলে পড়ে না। ছবিতে পাওয়া যায় খুব ফ্যাকাসে, মরা এক আলো, সাদাতে আকাশে মেঘের কোন ডিটেল নাই, উজ্জ্বল কোন রঙ নাই, চোখ ধাঁধানো নন্দন নাই। নাটকের যেন বড়ই অভাব। ফটোগ্রাফার কি নাটকীয় ছবি তুলতে পারেনা? নাকি সে সেরকম ছবি আর তুলতে চায় না?

 

ফিরিস্তি

মুনেম ওয়াসিফ ও তানজিম ওয়াহাব

…ওয়াসিফ: জিনিসটা যথেষ্ট ভাঙ্গছে। আসলে বাংলাদেশের এই ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট সোশ্যাল ডকুমেন্টরি নিয়া আমরা যতটুক ভীত, এত ভয় পাওয়ার কিছু নাই। আপনি যদি একটু গোনেন আমার কাছে মনে হয় না এদেশে সোশ্যাল ডকুমেন্টরির সাত আটটা ক্লাসিক কাজ বের হবে।

তানজিম: ক্লাসিক বলতে আপনি কি বুঝাইতেছেন?

ওয়াসিফ: ক্লাসিক বলতে, মানে কালজয়ী। ঋত্বিক ঘটকের মেঘে ঢাকা তারা কিংবা সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালির মত, যুগে যুগে মানুষ যেটা মাইল স্টোন হিসাবে দেখবে।

তানজিম: আপনাকে আমি জিগাইলাম কারণ আপনার কথায় অনেকে আবার ক্লাসিক বলতে ডকুমেন্টরিতে ক্লাসিক এপ্রোচ না ভাবে। একটা অভিযোগ হইল এ জায়গায় ডকুমেন্টরিতে বেশি দেখা যায় ক্লাসিক এপ্রোচ, মানে গল্প বলার পুরানা পদ্ধতি এবং আধুনিক যুগে অনেকে ভাবে এইটা আমগো পিছায়া দিতাছে।

ওয়াসিফ: সেই একটা জায়গায় সাত আটটা স্ট্রং কাজ হইছে, হুইচ ইজ ফেয়ার এনাফ। এবং আমার কাছে মনে হয় পরের জেনারেশন এইটার মধ্যে অনেক ইন্টারেস্টিং টুইস্ট দিছে এবং অনেক জায়গা তৈরি হইছে। ধরেন সেইখানে রাসেলের মত ফটোগ্রাফার একটা আরবান ল্যান্ডস্কেপ করতেছে, কালারে একদম মেলানকোলিক একটা স্যাড কালার টোন, সেখানে ধরেন তুশিকের মত ফটোগ্রাফার তার নিজের জীবনের সুইসাইডাল টেন্ডেন্সি নিয়া ছবি তুলছে।

তানজিম: কিংবা সুমনের মত ফটোগ্রাফার তার সেলফ পোর্টেট এবং নিজের মায়ের সাথে স¤পর্ক নিয়ে কাজ করছে, ব্যক্তিগত ইমোশন দিয়া…

ওয়াসিফ: হু… তার সাথে সাথে কিন্তু আমার ধারণা এই ভিন্নভাবে গল্প বলার চেষ্টা অনেক আগে থেকেই ছিল। ধরেন মুন্নি আপা বহু আগে তার ফ্যামিলি নিয়ে একটা স্টোরি করছে কিংবা সামিরা বহু দিন আগে ছবি এবং টেক্সট ওভারলেপ করে ইন্টারেস্টিং কাজ করছে। কিন্তু যেটা হইছে, ভিন্ন কাজগুলা করার যে প্রবণতা ছিল, সেটা কোন কারণে উৎরাইয়া যায় নাই, স্টাবলিস্ট হয় নাই, কোন কারণে ইন্টারন্যাশনালি লিংকড হয় নাই। কিংবা আমরা এই কাজগুলাকে পাটাতন দিতে পারি নাই। ফলে সেই কাজগুলা হারাইয়া গেছে। আবার এখন যে নতুন কাজ হইতেছে, যেটা আমাদের কাছে দেখে র‌্যাডিক্যাল মনে হইতেছে, মনে হচ্ছে যে ক্লাসিক্যাল ডকুমেন্টরি ফটোগ্রাফিতে এইটা টুইস্ট মারছে। ফটোগ্রাফাররা অনেক বেশি পার্সোনাল, ইন্টিমেট, কমপ্লি­কেটেট স্টোরি বলতেছে, এইটা কিন্তু একটা সময় ক্লিসে হয়ে যেতে পারে। যেইটা এখন ইনডিয়ায় হইছে। সব ফটোগ্রাফারই একটা মিডিয়াম ফর্মেটে, সেøা, বোরিং, একধরনের মিডিল ক্লাসের গল্প বলে। এবং সেই ছবিগুলা গ্যালারিতে যায় এবং গ্যালারিতে গেলে সেটা একটা এডিশনে বিক্রি হয়। এবং সেটা হিস্ট্রিক্যালি ফটোগ্রাফির নানান রকম কনটেক্সটের সাথে জড়িত বলে একটা থিউরিটিক্যাল প্যাঁচাল হয়। সো আমার কাছে মনে হয় প্রত্যেকটা সময়ই একটা নতুন গল্প বলার ধরন আসে, কিন্তু সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ হল, যে গল্পটা আপনি বলেছেন সেই গল্পটার সাথে আপনি কানেক্টেড কি না। কিংবা আপনি ফিল করেন কি না।

তানজিম: সেই জায়গাটায় আমি বলি ‘ভিন্ন’ এবং ‘নতুন’ এই দুইটা শব্দই একধরনের ট্র্যাপ। আমরা ‘ভিন্ন’ বলতে আসলে কি বুঝাই? ‘ভিন্ন’ কি শুধুই আসলে ভিন্ন কিছু করার জন্যই? শুরুতে আমাদের কিন্তু সেরকম আর্গুমেন্ট ছিল না, আর্গুমেন্টটা ছিল একজন নতুন ফটোগ্রাফার আসলে কতগুলা জানলা খোলা পায় এবং সে কত বৃহৎ ভাবে ডকুমেন্টরিটা বুঝতে পারে। তারপর যেই জায়গাটা তাকে টানে, যে জায়গাটায় সে কানেক্টেড ফিল করে, নিজের সাথে সম্পর্ক খুঁজে পায়, যেটা সে বিশ্বাস করে, কিংবা যেটা তাকে অনেক এক্সাইটেড করে, ইন্সপাইয়ার করে, সে ঐ কাজটা নিবে। তার জন্য ইন্ডাস্ট্রিতে সেই সুযোগ আছে কি না?

ওয়াসিফ: আমার কাছে একটা জিনিস মনে হয়, আমরা আসলে অনেক বেশি ফটোগ্রাফির ভিতরে আছি। এবং অনেক ধরনের ফটোগ্রাফিক স্কুল, দেখা, রাজনীতি এইগুলা নিয়া আমরা আসলে এত জর্জরিত! মাঝে মাঝে আমরা ফটোগ্রাফির যে একটা খুব সাধারণ, ইনোসেন্ট বিউটি আছে সেটার কথাও ভুলে যাই। কিন্তু ওইটাই আমার কাছে মনে হয় ডকুমেন্টরি ফটোগ্রাফির সবচেয়ে বড় স্ট্রেঙথ। ধরেন, মানে বাংলাদেশেই ধরেন, আমার খুব মজার লাগে ফ্যামিলি এ্যালবামে যে ছবিগুলা দেখা যায়, কিংবা ধরেন আমরা এইবার যে ছবিগুলা ছাপাচ্ছি, মানে হিন্দুরা মরা মানুষের যে ডকুমেন্ট করে, কিংবা ধরেন পুলিশ কিংবা মেডিকেলে কেস স্টাডির মত করে যে ছবিগুলা তোলা হয়, কিংবা যুদ্ধে আর্মির একজন ফটোগ্রাফার একদম ফটোগ্রাফিক এপ্রোচ বাদ দিয়ে একদম নিখাদ ডকুমেন্ট করার জন্য যে ডকুমেন্টগুলা করে… আমার কাছে মনে হয় ফটোগ্রাফির একটা ইন্টারেস্টিং জায়গা হইল ফটোগ্রাফাররা ছাড়াও এই ফটোগ্রাফি এবং ফটোগ্রাফ, দুইটা জিনিসকে নানান মানুষ নানানভাবে ব্যবহার করে। এবং এটা যদি আপনি ভাল করে দেখেন, এটার ভিতরে অনেক ভাঁজ আছে। এটার ভিতর অনেক তরিকা আছে এবং অনেক ইনোসেন্স, নাইভ, ইন্টারেস্টিং দেখার জায়গা আছে। আমাদের মাঝে মধ্যে এই জ্ঞানের গরিমা থেকে বের হয়ে একটু সহজ মনে ছবিগুলো দেখা দরকার। তাইলে হয়ত অনেকগুলা ছবি আমাদের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠবে। ইন দ্যা এন্ড অফ দ্যা ডে, আপনি আসলে কোন স্কুলে কেমনে কি ডকুমেন্ট্রি ফটোগ্রাফি করবেন এইটা ইম্পরট্যান্ট না, কাজটা যদি আসলেই ভাল হয় এবং ওটার ভিতর যদি প্রাণ থাকে, ওটা যুগের পর যুগ ধরে টিকে থাকবে।

তানজিম: হ্যাঁ। কিন্তু আরেকটা জিনিস হইল, যে ছবিটায় প্রাণ দিল, দরদ দিয়া তুলল, এই ছবিটা আমরা আসলে তুলি কার জন্য? আমরা কখনও তেমন একটা বলি না যে কারে দেখানোর জন্য ছবি তুলি। অলরেডি ইন্ডাস্ট্রির কথা বলছি, গ্যালারির কথা বলছি, পৃষ্ঠপোষকতার কথা বলছি, বলছি আমি কি দেখাইতে চাই, আমি কি করে কানেক্টেট, কিন্তু এই ছবিগুলোর দর্শক কে? তারা আসলে কোন ছবিগুলা খুঁজে? কই ছবিগুলা পায়? যেমন আপনি বললেন যে অদ্ভূত কিছু ছবি আছে যেইটা ফ্যামিলির ছবি, বাংলাদেশে কিন্তু এই রকম ছবি নিয়া ইন্টারেস্টিং কিউরেশন এখনও হয় নাই। কেবল শুরু হচ্ছে ছবিগুলাকে ভাল করে দেখা, সংরক্ষণ করা, ছবিগুলাকে দেখানো। আমরা বাংলাদেশে যে ডকুমেন্টরি ফটোগ্রাফি করি, এইটা স্পেসিফিক্যালি এজেন্সি ওরিয়েন্টেড বা বিদেশি গ্যালারি ওরিয়েন্টেড, সাধারণ মানুষের আসলে ছবি দেখা খুব বেশি হয়ে ওঠে না বাংলাদেশে।

ওয়াসিফ: সেটা একদিক থেকে সত্যি এবং এই কথাটার অনেকগুলা ভাঁজ আছে। আমার কাছে মনে হয় ডকুমেন্টরি ফটোগ্রাফির ক্ষেত্রে এইটা খুবই ইম্পরট্যান্ট। যেমন ধরেন সালগাদো যে ধরনের কাজ করে। আমরা খালি সালগাদোর সেই ছবিগুলাই দেখি যেগুলা জায়ান্ট, এপিক, ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট হিউজ স্টোরি। কিন্তু এর সাথে সাথে সালগাদোর একটা খুব ইন্টারেস্টিং এক্সিবিশন ছিল, ল্যাতিন আমেরিকার ট্রেনের ভিতরে ছবি পেস্ট করছে এবং সেই ট্রেনটা ল্যাতিন আমেরিকার বিভিন্ন শহরের মাঝখান দিয়ে গেছে এবং স্টেশনে যখন ট্রেনটা দাঁড়াইত, যাত্রীরা ঢুকত আর বের হইত এবং তারা ছবিগুলো দেখত, খুব ইন্টারেস্টিং কিন্তু। কিংবা ধরেন সুসান মাইসেলাস যখন তার তোলা নিকারাগুয়ার যুদ্ধের ছবি যুদ্ধের ২৫-৩০ বছর পর গিয়ে এক্সাক্টলি সেম লোকেশনে, যেখানে ছবিটা তুলছে, সেখানে ছবিগুলা এক্সিবিট করে এবং পাবলিকের সাথে যে ইন্টারেকশন হয় সেটাও খুব প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। কিন্তু অন্য জায়গা থেকে আমার আরেকটা জিনিসও মনে হয় যে, সব ডকুমেন্টরি ফটোগ্রাফার যে ছবি দেখায় তা কিন্তু না। যেমন ধরেন কুদেলকা সারা জীবন অনেক কাজ করছে। কিন্তু খুব অল্প ছবি আমরা দেখতে পাইছি। যেমন ধরেন লাস্ট ১০ বছরে কুদেলকা কোন ছবি কাউকে দেখায় না। কিংবা ধরেন একজন স্ট্রিট ফটোগ্রাফার। কয়েকদিন আগে বলা হইছে রবার্ট কাপা আর তার বউ এর মেক্সিকার একটা সুটকেস আবিষ্কার হইছে, সেইখানে তাদের মেক্সিকো ট্রিপের হাজার হাজার নেগেটিভ ছবি। তো আমার কাছে মনে হয়, এখনকার ফটোগ্রাফির চল অন্যরকম। ডিজিটাল ক্যামেরা আসছে, আপনি একটা এজেন্সির সাথে রিলেটেড, সো ছবি তোলেন আর সাথে সাথে ডাউনলোড করেন। কি ওয়ার্ডটা ফিল ইন করেন, প্লাগ কানেক্টেড করেন, ছবি নিউইয়র্ক টাইমস-এ চলে যায়। নিউইয়র্ক টাইমস এর ব্লগে আপনার ছবি দেখা যায়, সেই ছবি আপনি আবার ফেইসবুকে পোস্ট করেন। সেখানে একশটা লাইক পরে এন্ড ইউ আর ইন এ কম্পিটিটিভ, সুপার স্পিড ফ্রেম ওয়ার্ক। সবসময় কিন্তু জীবনটা এই রকম হওয়ার কথা না, কিংবা সবসময় তাড়াহুড়া করে ছবি তোলারও দরকার নাই। আপনার কিন্তু দম নেবার সময় আছে এবং স্থির হবার সময় আছে। ধরেন ফটোগ্রাফিতো অনেক সময় জীবনানন্দ দাশের কবিতার মত করেও হতে পারে। আপনি আপনার নিজের খাতায় লিখবেন এবং সেটা রাখবেন। দীর্ঘ দিনে ছবিটার সাথে কিংবা কবিতার সাথে সাথে বড় হবেন এবং একটা পর্যায়ে গিয়ে হয়ত প্রকাশ করবেন।

ঘোলাটে ছবির আখ্যান

তানজিম ওয়াহাব

 

স্যালন  ফটোগ্রাফির আলোচনায় স্যালন  পেইন্টিং থেকেই ঘুরে আসতে হবে। প্যারিসে ১৭২৫ সালে স্যালন’’র প্রচলন ঘটে যখন ফরাসি সরকার শিল্পমান যাচাই আর শিল্পপ্রদর্শনী আয়োজনের লক্ষে তৈরি করে এক একাডেমি একাদেমি দে ব্যু আর্ট)। একাডেমি স্বীকৃত না হলে কারো ছবি প্রদর্শন হতো না, যার সিদ্ধান্ত নিত শুধুমাত্র সরকার নির্ধারিত বাক্তিবর্গ। তাদের পছন্দের তালিকায় ছিল বাইবেলীয় আখ্যান , পৌরাণিক বিষয়বস্ত যা শিল্পীর কল্পনাশক্তি নান্দনিকভাবে উপস্থাপন করে বটে, তবে তা বাস্তবতা বিবর্জিত। চিত্রকলার ইমপ্রেসনিজম আন্দোলনের সময় এই ধারার প্যারিস স্যালনের সাথে ইম্প্রেসনিস্ট শিল্পীদের সরাসরি সংঘাত ঘটে। প্যারিস স্যালনের শিল্পের একক সংজ্ঞায়ন তারা নাকচ করে দেয়। যেমন ধরুন শিল্পে নগ্নতা নিয়ে প্যারিস স্যালনের ভাষ্য। তাদের ভষ্য মানুষের নগ্নতা (বিশেষ করে নারীর) শিল্পে শুধুমাত্র উত্তীর্ণ হতে পারে যখন তা আবেদনময়, কিন্তু নেংটো উপস্থাপন হল শিল্পবিমুখ অশ্লীলতা। ইংরেজিতে ন্যুড আর নেকেড এর সংজ্ঞায়ন জটিলতা বলতে পারেন। বুঝেন ঠ্যালা? ইমপ্রেসনিস্ট আর রিয়েলিস্ট শিল্পীরা প্রতিবাদস্বরূপ রীতিমত ব্যাঙ্গ করা শুরু করল। রিয়েলিস্ট পেইন্টার অনরে দোমিয়ের সেইসময়ের অসংখ্য ক্যারিকেচার স্যালন পেইন্টিংকে ব্যাঙ্গ করে বুর্জোয়া শিল্পচর্চা হিসেবে।

বিতর্ক শুরু হলেও  স্যালন  পেইন্টিং তার নির্দিষ্ট চরিত্রেই অনড় থাকে- অতি নান্দনিক, কাল্পনিক দৃশ্যায়ন, আলোছায়ার নাটকীয়তা আর সুন্দর, মঙ্গলময় জীবনের গুণকীর্তন। । কেন হঠাৎ স্যালন পেইন্টিং নিয়ে বললাম?

সাতটি ছবি সাতটি গল্প

…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..

আমানুল হক

তানজিম ওয়াহাব

আমানুল-এর কেনা চোরাবাজারের সেকেন্ড হ্যান্ড জাপানী ক্যামেরা, তার কুঁজো, রোগা শরীরের ছিপছিপে গড়ন, খুব সাধারণ ঢিলে হাতা খদ্দরের পাঞ্জাবি, পায়জামা আর চপ্পল, মৃদু কণ্ঠের পরিমিত আলাপচারীতার সাথে ছবিটি মেলানোর চেষ্টা করছি। রীতিমত হিমশিম খাচ্ছি। শক্তিশালী কম্পোজিশন। দু’হাত মেলে দিয়ে দানবীয় ভঙ্গিতে এক মানব শরীর। পেছন থেকে তোলা, চেহারা দেখা যায় না, তবে আসল চেহারাটা অনুভূত হয়। ছবির মানুষটি নিয়ে একটু পরেই বলি, ছবির পেছনের যে মানুষ …

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….

নাইব উদ্দিন আহমেদ

মুনেম ওয়াসিফ

কিন্তু ছবি তোলা হলেই তো হবে না, সেই নেগেটিভ ধোলাই করা থেকে প্রিন্ট তৈরি পর্যন্ত সব কাজ তিনি নিজের হাতে করতেন। অন্ধকার ঘর, টেবিলের চারপাশে কাঁথা মুড়ানো আর হারিকেনের লাল সেলোফেন থেকে আসা আলতো আলো দিয়ে চলত ডার্করুমের কাজ। পানির ভিতর থেকে একটি সাদা কাগজ। লাল আলো। তার ভিতর থেকে আস্তে আস্তে ছবি বেরিয়ে আসতে দেখার যে কি প্রবল উত্তেজনা, তা এই প্রজন্মের অনেক আলোকচিত্রি বুঝবে না …

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….

ড: নওয়াজেশ আহমেদ

তানজিম ওয়াহাব

ছুটি পেয়ে রবীন্দ্রনাথের ফুলবাগানের ফুলগুলো অসংযত উচ্চহাসি দিলেও নওয়াজেশের ছবিতে তারা সম্পূর্ণ উল্টো ভঙ্গিতে। এখানে তারা প্রচণ্ড সংযত, পরিপাটিভাবে ফুলদানিতে সাজানো। এলোমেলোভাবে হেলাদোলার বদলে প্রচণ্ড স্থির, ঠাণ্ডা।  চৈত্রের পড়ন্ত রোদ তাদের পিঠে এসে না পড়লেও জানালার ফাঁক দিয়ে আলতোভাবে ছুঁয়ে যাচ্ছে। বাঁকাপথে আসার সময় কুঁচি কুঁচি হয়ে আলো কেটে আসছে জানালার গ্রিল থেকে …

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….

আনোয়ার হোসেন

মুনেম ওয়াসিফ

আমরা এখানে মায়া, আনোয়ার হোসেন, তাদের ঘর কিংবা আর কিছু দেখতে পাই না। কেবল একটি হাত, কাঁচি, সুতো আর সুই। এতো অল্পে কিভাবে জীবনের গল্প হয়ে যায়! এভাবেই আনোয়ার হোসেন মরা পাখি, স্যান্ডেল, পুরানো কাঁচি, তাবিজ, পানের ডিব্বা, কিংবা প্রিয় মানুষের শরীরের অংশবিশেষ নিয়ে এসেছেন তার এই কাজে। সরল, পরিমিত, স্বচ্ছ অথচ ছবিগুলো জার্মান টাইপোলজির মতো আবেগহীন নয়। এইগুলো আনোয়ার হোসেনের বেড়ে উঠার আখ্যান, একেকটি সাংকেতিক গল্প।

ফিরিস্তি

মুনেম ওয়াসিফ ও তানজিম ওয়াহাব

 

তানজিম: এবং ট্যাবুর কিন্তু শেষ নাই যেমন কালার ফটোগ্রাফির কথা চিন্তা করেন,ছবিতে যদি কালার উজ্জ্বল না থাকে,অনুজ্জ্বল কালার হইলে সেটা কালার ছবি হইলো না। এই ধরনের ট্যাবুও কি আপনার মনে হয় না এখনো…

ওয়াসিফ: আমার কাছে মনে হয় যে এইটা আসলে খুব হাস্যকর, আমার কাছে মনে হয় মূলত এমেচার  ফটোগ্রাফারদের এই ট্রেন্ডটা বেশী থাকে। ঐ যারা একটু ক্লাব ফটোগ্রাফি করে তারা মনে করে নীল আকাশকে গাঁঢ় নীল,সবুজ ঘাসকে হলুদ ঘাস বানাইয়া দিলাম। তাইলেই হয়তো ছবিটা ইন্টারেস্টিং হইয়া গেল। কিংবা ছবিটা একটু ঘোলা ঘোলা হইলেই মনে হয় আর্ট হইয়া যায়। বাংলাদেশের আসলে ফটোগ্রাফি কি আদৌ আর্ট কি না,এ নিয়েই তো আমাদের এখনও যুদ্ধ চলতেছে,ধরেন আমাদের ঘরের ভিতরেই এখনো ফটোগ্রাফি আসলে সেই অর্থে আর্ট হিসেবে স্বীকৃত না।

তানজিম: আমিতো বলবো হ-জ-ব-র-ল অবস্থা,তবে আমি শুধু ফর্ম দিয়ে এটাকে দেখি না,আমার কাছে মনে হয় এইখানে কন্টেন্টটাও এক অর্থে গুরুত্বপূর্ণ। যেমন ধরেন আর্ট ফটোগ্রাফির যারা চর্চা করে বা আমরাই নিজেরাইতো চর্চা করি,সেখানে আর্ট ফটোগ্রাফির মানেই যেনও সুন্দর ছবি অথচ একটা সামাজিক কোন সমস্যা বিষয়ক ছবি তুললে সেটা যেনও আর্ট ফটোগ্রাফি না, সেটা যেন একটা সাংবাদিকের চোখ দিয়ে দেখা কিংবা সেটা একধরনের  ভিন্ন সোশ্যাল ডকুমেন্টারির ছকেই ফেলে দেয়া। কোনো স্ট্রাগল বা সংগ্রাম বা কোনো কিছুর মধ্যে বিমর্ষতা যেন আর্ট ফটোগ্রাফি হইতে পারে না।

ওয়াসিফ: আমাদের এইখানে এখনও আর্ট ফটোগ্রাফি মানে হচ্ছে যে কোনো জিনিসের সুন্দর দেখানো, মানে-একধরনের ঐ সুগার কোটেট ছবি তোলা আর সোশ্যাল ডকুমেন্টারি মানে হচ্ছে গরিবের দুঃখ,কষ্ট,ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট,হার্ড কন্ট্রাস্ট-এ ছবি তোলা। আমার কাছে মনে হয় দুইটাই স্টেরিও টাইপ এবং দুইটাই ক্লিশে