নিঃসঙ্গ প্রকৃতির রূপকার

ডঃ নওয়াজেশ আহমেদ

আলাপচারিতা: নাসির আলী মামুন

 

নওয়াজেশ আহমেদ: তখন আমার সঙ্গে ছিলেন বর্তমানে জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। উনিও একজন মেম্বার ছিলেন। আমাকে বলছিলো, আপনি কলকাতায় যান। কলকাতায় গিয়ে আরো কিছু ছবি বেছে নিয়ে এসে এটা করেন। আমি একটা অজুহাত দেখালাম যে কলকাতা যেতে পারবো না। না গিয়ে বুদ্ধি করে এখানে দু’’টো পার্ট করলাম। একটা স্বাধীনতা আর মুক্তিযুদ্ধের ওপর, বাকিটা রূপসী বাংলা, ‘হে বাংলা আমার। কার জন্য যুদ্ধ?’ এই বাংলার জন্যই তো, যে জন্য আমাকে প্রচুর বিরোধিতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিলো। কেউ ছবি দিতে চাচ্ছিলো না।  অ্যানি ওয়ে, আমি বলবো যে  আমাদের ওই এক্সিবিশনটা খুবই সাকসেসফুল, সত্যিকারের উন্নতমানের একটা জাতীয় প্রদর্শনী হয়েছিলো। স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রচুর ছবি ছিলো, আরেকদিকে গ্রাম বাংলার ছবি। আমরা বলেছিলাম যে যদি এই পোরশনটা না দেখাই, তবে আমাদের আলোকচিত্র স্থান পাবে না। বঙ্গবন্ধু আসলেন, দেখলেন, খুবই খুশী হলেন এবং বললেন যে, ‘তোরা আর কি কি করতেছস?’ যেহেতু আর্ট কলেজের মধ্যে হচ্ছিলো, ওখানে আর্ট কলেজের প্রিন্সিপালও ছিলেন। তখন প্রিন্সিপাল ছিলেন জয়নুল আবেদীন। তাকে আমি বললাম, তিনি বললেন যে, ‘হ্যাঁ, এটা তো ভালো কথা। এটা তো আমাদের অনেক আগেকার আইডিয়া ছিলো’। বললেন, ‘নায়েবউদ্দীনকে ডাক দেন। কারণ তার কতগুলি প্রিয় লোক ছিলো। আমানুল হককে একটু ডাকেন’।

আমি এদেরকে ডেকেছিলাম। আমানুল হক সাহেব অসুস্থ থাকায় আসেননি। নায়েবউদ্দীন সাহেব, আমি, কিছু প্রেস ফটোগ্রাফার ছিলাম। সব মিলে বলা হলো আবেদীন সাহেবকে, ‘আপনি যেটা করতে পারেন’। আমাকে বললো, যেহেতু আমি বহু দেশ ঘুরে এসব আর্ট ইন্সটিটিউট দেখেছি। আমাকে বললেন, ‘আপনি কোন জায়গায় কি দেখেছেন বলেন’। আমি বললাম, স্পেশালাইজড হয় দুই বছর। সিনেমাটোগ্রাফি এখন না, কারণ এটা একটু হেভি। কিন্তু স্টিল ফটোগ্রাফি করা যেতে পারে। উনি রাজি হলেন। তারপর ’৭৫ এসে গেলো। গন্ডগোল হলো। আমিও দেশ ছেড়ে কাজে গেলাম। পরবর্তীতে জিনিসটা ভাটার মধ্যে চলে গেলো। কিন্তু আলোকচিত্রীদের মধ্যে একটা দল বললো যে, তারা আর্ট কলেজের সঙ্গে না রেখে নিজস্ব একটা ইন্সটিটিউট করবে। আমার মনে হয় সেটা একটা ফ্যাক্টর।

নাসির আলী মামুন: এই দলে কারা ছিল?

নওয়াজেশ আহমেদ: আমি ঠিক জানি না। আমি তখন দেশের বাইরে। শুনলাম। আর্ট কলেজের কাইয়ুম চৌধুরী, যারা গ্রাফিক্স নিয়ে কাজ করে তারা খুব ইন্টেরেস্টেড ছিলো। তারা আমাকে বললো যে ফটোগ্রাফাররা তো অন্য কথা বলে…..

সাতটি ছবি সাতটি গল্প

…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..

আমানুল হক

তানজিম ওয়াহাব

আমানুল-এর কেনা চোরাবাজারের সেকেন্ড হ্যান্ড জাপানী ক্যামেরা, তার কুঁজো, রোগা শরীরের ছিপছিপে গড়ন, খুব সাধারণ ঢিলে হাতা খদ্দরের পাঞ্জাবি, পায়জামা আর চপ্পল, মৃদু কণ্ঠের পরিমিত আলাপচারীতার সাথে ছবিটি মেলানোর চেষ্টা করছি। রীতিমত হিমশিম খাচ্ছি। শক্তিশালী কম্পোজিশন। দু’হাত মেলে দিয়ে দানবীয় ভঙ্গিতে এক মানব শরীর। পেছন থেকে তোলা, চেহারা দেখা যায় না, তবে আসল চেহারাটা অনুভূত হয়। ছবির মানুষটি নিয়ে একটু পরেই বলি, ছবির পেছনের যে মানুষ …

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….

নাইব উদ্দিন আহমেদ

মুনেম ওয়াসিফ

কিন্তু ছবি তোলা হলেই তো হবে না, সেই নেগেটিভ ধোলাই করা থেকে প্রিন্ট তৈরি পর্যন্ত সব কাজ তিনি নিজের হাতে করতেন। অন্ধকার ঘর, টেবিলের চারপাশে কাঁথা মুড়ানো আর হারিকেনের লাল সেলোফেন থেকে আসা আলতো আলো দিয়ে চলত ডার্করুমের কাজ। পানির ভিতর থেকে একটি সাদা কাগজ। লাল আলো। তার ভিতর থেকে আস্তে আস্তে ছবি বেরিয়ে আসতে দেখার যে কি প্রবল উত্তেজনা, তা এই প্রজন্মের অনেক আলোকচিত্রি বুঝবে না …

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….

ড: নওয়াজেশ আহমেদ

তানজিম ওয়াহাব

ছুটি পেয়ে রবীন্দ্রনাথের ফুলবাগানের ফুলগুলো অসংযত উচ্চহাসি দিলেও নওয়াজেশের ছবিতে তারা সম্পূর্ণ উল্টো ভঙ্গিতে। এখানে তারা প্রচণ্ড সংযত, পরিপাটিভাবে ফুলদানিতে সাজানো। এলোমেলোভাবে হেলাদোলার বদলে প্রচণ্ড স্থির, ঠাণ্ডা।  চৈত্রের পড়ন্ত রোদ তাদের পিঠে এসে না পড়লেও জানালার ফাঁক দিয়ে আলতোভাবে ছুঁয়ে যাচ্ছে। বাঁকাপথে আসার সময় কুঁচি কুঁচি হয়ে আলো কেটে আসছে জানালার গ্রিল থেকে …

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….

আনোয়ার হোসেন

মুনেম ওয়াসিফ

আমরা এখানে মায়া, আনোয়ার হোসেন, তাদের ঘর কিংবা আর কিছু দেখতে পাই না। কেবল একটি হাত, কাঁচি, সুতো আর সুই। এতো অল্পে কিভাবে জীবনের গল্প হয়ে যায়! এভাবেই আনোয়ার হোসেন মরা পাখি, স্যান্ডেল, পুরানো কাঁচি, তাবিজ, পানের ডিব্বা, কিংবা প্রিয় মানুষের শরীরের অংশবিশেষ নিয়ে এসেছেন তার এই কাজে। সরল, পরিমিত, স্বচ্ছ অথচ ছবিগুলো জার্মান টাইপোলজির মতো আবেগহীন নয়। এইগুলো আনোয়ার হোসেনের বেড়ে উঠার আখ্যান, একেকটি সাংকেতিক গল্প।