ফটোগ্রাফি উইদাউট ক্যামেরা!

বিজন সরকার

আলাপচারিতা: মুনেম ওয়াসিফ

মুনেম ওয়াসিফ: তো, আপনার একভাই তো সাইনবোর্ড ব্যানার এসব আঁকতেন, আরেক ভাই কী করতেন?

বিজন সরকার: সে-ও এই কাজই করতেন। যেহেতু তাঁরা তিন বছরের বড়-ছোট ছিলো, তো ন্যাচারালি ফ্রেন্ডসও হয়েছে সেরকম । আর আমি বড় ভাইয়ের তের বছরের ছোট। বিরাট একটা গ্যাপ রয়েছে। গ্যাপের জন্যই বোধহয় আমার ভাইয়ের প্রতি আলাদা একটা ভালোবাসা ছিলো, আবার বিস্ময়করও ছিলো যে উনি বহু কাজ করতেন। বহু কাজ করতো বলতে এইটা মনে হয় প্রতিভাবানদের ব্যাপারে কথাটা হল জুতা সেলাই থেকে চণ্ডিপাঠ পর্যন্ত একটা কথা আছে মানে যা পায় তাই করে এরকম আর কি! সে একসময় কম্পাউন্ডারিও করসে।

মুনেম ওয়াসিফ: তো, সে এরকম নানান কাজে পারদর্শী ছিলো?

বিজন সরকার: নানান কাজে। মানে, আমি যতদূর জানি আর কি! দোকানের হিসাব রাখার কাজ করত, আবার কম্পাউন্ডারিও করতো। বিভিন্ন লেখালেখি এইসবের মধ্যে ছিলো। সে ছবি আঁকাতে যখন আরেকটু বেশি দিন কাটালো, অনেক কিছু করলো, তখন সে মূর্তি বানানো শুরু করলো। প্রতিমা-স্বরস্বতী, লক্ষ্মী এগুলো। স্বরস্বতী পূজা তো আমাদের ব্যাপকভাবে প্রচলন আছে। তো মূর্তি বানানোর ক্ষেত্রেও অনেকরকম জ্ঞান দরকার। আমি ছোটবেলায় দেখেছি, যে মাটিটা ছানতো, ঐ মাটির ভেতরে আগে পাট কেটে দিতো, পরে আবার ধানের তুষ মেশাচ্ছে। আমি বলি ‘এগুলা দিলে কেন?’ ও বলে ‘এইটা আরো ছোট অংশে মাটি ধরে রাখে’, এইরকম আরো কি সব বললো যেটা মনে নাই। উনার এক আর্টিস্ট ফ্রেন্ড ছিলো কলকাতায়। উনাদের যে কাজ-কাম বা বিচরণ সবই কলকাতা ভিত্তিক আর কি। সেই কারণে পাকিস্তান যখন আলাদা  হলো তখন উনি আসামে ছিলেন। উনি এই ধরনের নানান সৃজনশীল কাজের মধ্যেই ব্যাপ্ত ছিলেন… যেহেতু ভাইয়ের অনুপ্রেরণা আমি পেয়েছি, তাই কিছুটা বলতেই হবে। উনি বোধহয় ফোরটি ফাইভ এর দিকে, কিংবা ফোরটি ফোর এর দিকে হতে পারে, মিনিট ক্যামেরা ব্যবহার করতেন। পেপার নেগেটিভ।

মুনেম ওয়াসিফ: কিন্তু আপনি প্রথম ক্যামেরা হাতে পাইলেন কবে বা শুরু করলেন কবে?

বিজন সরকার: এই অনুপ্রেরণাটার প্রয়োজন আছে, সেইজন্যই বলি। এর মাঝখানের পিরিয়ডে, বড় ভাই কথা-বার্তা বলতো ছোটভাইয়ের সাথে। আমার সঙ্গে না, আমি তো তখন কথা বলার অযোগ্য। দশ বছরের ডিফারেন্স, আমার সঙ্গে কী কথা বলবে? মেঝ ভাইকে বলতো, লাইটিং সম্বন্ধে। তারপর একটা ভেরি ইম্পোর্ট্যান্ট কথা বলেছে। নাচে বা গানে পুরস্কার পেয়েছে, এটা নিয়ে বলছেন যে কোন বিচারক বিচার করেছে, সে কি বোঝে এই কাজ? কিংবা এরাই বা কার কাছে দেয় বিচার করার জন্য? কোনো শিল্প কোনোদিন বিচার করার অধিকার কারো নাই। ওই কথাগুলো বলছে। শিল্প তো হচ্ছে সাধনার বিষয়, এটা সারাজীবন শুধু সাধনা করে যেতে হয়। এর মাধ্যমেই যাবতীয় উত্তরণ হয়। কী অদ্ভুত কথা না?

মুনেম ওয়াসিফ: অনেক মূল্যবান কথা।

বিজন সরকার: অনেক মূল্যবান কথা না? এটা ভাইয়ের কাছ থেকে শোনা। ভাই তো আমাকে পাত্তাই দেবে না, এই কথা শোনাবে? ‘এই ভাগ, ডিস্টার্ব করিস না’, এই কথা বলতো আর কি! কিন্তু এই কথা ভাইয়ের কাছ থেকে শুনেছি। তারপর লাইটিং সম্বন্ধে বলত, কোথায় কোন লাইটিং। ধরেন, এখানে বসলে ডান দিকের যে লাইটিংটা আসবে, এই লাইটেই এইদিকে মুখটা ঘোরালে পরে দুই মুখেই আসবে। এদিকটা শেড, এইদিকটায়। এইসব কথা আমি তখনই বুঝতে পারতাম। তারপরে খোলা জায়গায় বারান্দায় একটা ঘর আছে, তার চাল নেই। তার সামনে যদি দুই-তিন হাত উপরে দিয়ে একটা কালো কাপড় মাথার ওপর দিয়ে দেয়া হয়, তাহলে পাসপোর্ট ছবি খুব ভালো আসবে। লাইট দুই দিকে যদি সমান থাকে তাহলে একরকম লাইট হবে, একদিক যদি বেশী থাকে থাকে তাইলে হালকা লাইট অ্যান্ড শেড হবে। চমৎকার কথা না? এইগুলা তো আমি জ্ঞান হওয়ার আগেই শিখেছি। বড় ভাই বলতো এইগুলো।

মুনেম ওয়াসিফ: তখন আপনার বয়স কত হবে? ৭-৮-১০ বছর? স্কুল-টিস্কুলে পড়েন তখন?

বিজন সরকার: বয়স হবে… পাকিস্তান যখন হয়, ৪৭-এ, তখন আমি ১২ বছর। হিসাবটা আসলে…

মুনেম ওয়াসিফ: আচ্ছা বয়স গুরুত্বপূর্ণ না, আপনি গল্পটা বলতে থাকেন, যে কথাগুলো শুনছেন সেই সময়।

বিজন সরকার: এই জিনিসগুলা আমি পরে বুঝলাম যে আমার যে অনেক ক্রিয়েটিভ জ্ঞান আসছে, এইটা নিশ্চয়ই আমার ভাইয়ের কারণে। এইরকম আরো অনেক কথা আমি আমার ভাইয়ের কাছে শুনেছি। সব মনেও নাই। কিন্তু ভাইয়ের কারণে আমার এই ক্রিয়েটিভ জ্ঞানটা হইসে। আমি এখন মনে করি অই যে আপনি আমার ওই ছবির ইন্টারভিউ নিতে চেয়েছেন, ঐটা আমি আর দিতে চাই না। চাই না এইজন্যে, যে কাজ আমি ষাটের দশকে করেছি, সেই কাজ আজও বাংলাদেশের কোনো ফটোগ্রাফার জানে না। ঔৎসুক্যও কেউ প্রকাশ করে নি। তাইলে আমি কি মনে করবো?…